পার্বত্য চুক্তির আগে তিন গণসংগঠন যে ৭ দফা রাজনৈতিক প্রস্তাবনা গ্রহণ করেছিল

সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরের ৯ মাস আগে ১৯৯৭ সালের ২৫-২৭ মার্চ ঢাকায় তিন দিন ব্যাপী এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে মিলিত হয়ে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, পাহাড়ি গণ পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দ পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্দোলনের ওপর ৭ দফা রাজনৈতিক প্রস্তাবনা গ্রহণ করেন।

উক্ত বৈঠকে তৎকালীন রাজপথের আন্দোলনে অগ্রণী তিন গণতান্ত্রিক সংগঠন (পাহাড়ি গণপরিষদ-পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন)-এর কেন্দ্রীয় ও মাঠ পর্যায়ের ২৭ জন নেতা-কর্মী অংশগ্রহণ করেন।

তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার জনসংহতি সমিতির সাথে বৈঠকের আড়ালে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণকে ধোঁকা দেয়ার চক্রান্তে লিপ্ত এবং ‘জেলা পরিষদের’ মত সমাধান চাপিয়ে দেয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত– এ আশঙ্কা রাজনৈতিক কর্মীসহ জনমনে প্রবল হয়ে উঠেছিল। এ প্রেক্ষাপটে তিন গণতান্ত্রিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ঢাকায় পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও ভবিষ্যত কর্মপন্থা নির্ধারণের লক্ষ্যে উক্ত বৈঠকের আহ্বান করেন। তিন দিন ব্যাপী নানা আলোচনা পর্যালোচনার পর বৈঠকে যে ৭ দফা রাজনৈতিক প্রস্তাবনা গৃহীত হয়েছিল সেগুলো হলো:

১. জেএসএস-এর মূল নেতৃত্ব সংশোধনবাদীতে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ জেএসএস নেতৃত্বের মধ্যে সংশোধনবাদী আপোষমুখী ধারাটা প্রধান্যে রয়েছে। পুরো সংগঠনটি একটি মহল বিশেষের “প্রাইভেট কোম্পানীতে” পরিণত হয়েছে এবং সেজন্যে এই দলটির দ্বারা পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতীয় মুক্তি লড়াইয়ে নেতৃত্ব প্রদান করা আর সম্ভব নয়।

২. জেএসএস-এর আপোষকামী ধারাটি বর্তমানে সরকারের সাথে আপোষ রফার জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। সম্ভাব্য আপোষ চুক্তির মধ্যে জনগণের পরিপূর্ণ মুক্তি অর্জিত হওয়ার ন্যুনতম সম্ভাবনা বর্তমান পরিস্থিতিতে নেই।

৩. প্রতিনিধিবৃন্দ যে কোন পরিস্থিতিতে মুক্তিকামী জুম্ম জনগণের আন্দোলনকে চূড়ান্ত লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

৪. পুরো জেএসএস-এর সাথে বাইরের তিন সংগঠনের নেতৃত্বের মধ্যে দ্বন্দ্ব নয়। প্রতিনিধিবৃন্দ আন্দোলনের সঠিক রাজনৈতিক লাইন প্রতিষ্ঠার জন্য মতাদর্শগত সংগ্রাম চালাবে এবং অপরদিকে জেএসএস-এর সাথে বিভিন্ন ইস্যু ও দাবী আদায়ের ক্ষেত্রে কৌশলগত ঐক্যর জন্য সংগ্রাম করবে।

৫. জেএসএস-এর সময়কার অর্থাৎ জাতীয় মুক্তি লড়াই’এর প্রথম দিকে প্রগতিশীল ও বিপ্লবী ভূমিকার কথা সশ্রদ্ধ চিত্তে স্বীকার করছে। কিন্তু বর্তমানে সংগঠনটি তার সেই চরিত্র হারিয়ে ফেলেছে।

৬. পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জাতিসত্তাসমূহের মধ্যে সমমর্যাদার ভিত্তিতে ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ঐক্য ও সংহতি অখণ্ড ও অবিভাজ্য। সকল জাতিসত্তার বিকাশের মধ্যে আমাদের উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও অস্তিত্ব নিশ্চিত সম্ভব।

৭. পাহাড়ি গণ পরিষদ, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের মধ্যে অধিকতর সংহতি জোরদার করার লক্ষ্যে অভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ ও শৃংখলা প্রতিষ্ঠা করা। এই লক্ষ্যে সমন্বয়ের জন্য একটি কমিটি গঠন করা তিন সংগঠনের মধ্যে সমমনা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দ্বারা।

উক্ত রাজনৈতিক প্রস্তাবনা আক্ষরিক অর্থে পরবর্তীতে পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন পার্টি গঠনের শর্ত ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন সম্পন্ন করে।

উল্লেখ্য, এর আগে আগে একই বছর ১০ মার্চ তিন গণসংগঠন ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের সম্মুখে আয়োজিত এক সমাবেশ থেকে পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন করেছিলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *