পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের ৩য় কেন্দ্রীয় সম্মেলন সম্পন্ন, ৩৩ সদস্যের নতুন কমিটি গঠিত

নিজস্ব প্রতিবেদক।। পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের ৩য় কেন্দ্রীয় সম্মেলন আজ শুক্রবার (১৩ মে ২০২২) খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়িতে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সম্মেলনে ৩৩ সদস্যের নতুন কমিটি গঠন কর হয়। এতে কণিকা দেওয়ান সভাপতি, পরিণীত চাকমা সাধারণ সম্পাদক ও সোনাদেবী চাকমা সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন।

সম্মেলন শুরুতে অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আত্মবলিদানকারী সকল শহীদদের সম্মানে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।

উদ্বোধনী সংগীত হিসেবে “উই শ্যাল ওভার কাম… গানটি পরিবেশনের মধ্য দিয়ে সম্মেলনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। সম্মেলনে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির বিভিন্ন উপজেলা থেকে ৫ শতাধিক নারী অংশগ্রহণ করেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামে নারী সমাজ এক হও, পাহাড়ি নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পূর্ণস্বায়ত্তশাসন কায়েম করো” এই শ্লোগানে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের সভানেত্রী মিনতি চাকমার সভাপতিত্বে ও পরিণীতা চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-এর কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সদস্য উজ্জল স্মৃতি চাকমা, পানছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান শান্তি জীবন চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নীতি শোভা চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বরুণ চাকমা, বৃহত্তর পার্বত্য চট্রগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ(পিসিপি)-এর চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মিটন চাকমা প্রমুখ। সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ২নং চেংঙ্গী ইউনিয়নের সাবেক সদস্য মানেক পুতি চাকমা। এছাড়া মঞ্চে আরো উপস্থিত ছিলেন ইউপিডিএফ’র পানছড়ি ইউনিটের সম্বনয়ক আইচুগ ত্রিপুরা ও সংগঠক জিরান চাকমা। 

ইউপিডিএফ নেতা উজ্জল স্মৃতি চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে দিন দিন নারী নির্যাতন-ধর্ষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। একইভাবে চলছে রাজনৈতিক ও জাতিগত দমন-পীড়ন। ইউপিডিএফ কর্মী সমর্থক সহ সাধারণ জনগণকে প্রতিনিয়ত অন্যায়ভাবে গ্রেফতার, খুন, মিথ্যা মামলা ও তল্লাশির নামে হয়রানিসহ নানা নিপীড়নের শিকার হতে হচ্ছে। এসব অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ সংগঠিত করতে চায় তাদের ওপর শাসকগোষ্ঠীর চড়াও হয়ে দমন-পীড়ন চালায়। যার উদাহরণ ১৯৯৬ সালের ১২ জুন লে. ফেরদৌস গং কর্তৃক হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী কল্পনা চাকমাকে অপহরণ ও ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল ইউপিডিএফে নেতা মাইকেল চাকমাকে গুম ও সম্প্রতি দীঘিনালায় ইউপিডিএফ সংগঠক নবায়ন চাকমা মিলনকে নির্যাতন চালিয়ে হত্যার ঘটনা। 

উজ্জ্বল স্মৃতি চাকমা আরো বলেন, নারীরাই সমাজের অর্ধেক শক্তি। নারীরা যদি রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়, আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে তাহলে যে কোন আন্দোলন সফল হতে বাধ্য। পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে নারী জাগরণ সৃষ্টি করতে হবে। নিজেদের ইজ্জত-সম্ভ্রম ও জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার্থে নারীদেরকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। তিনি নারী নির্যাতনসহ সকল ধরনের নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য নারী সমাজের প্রতি আহ্বান জানান।

উপজেলা চেয়ারম্যান শান্তি জীবন চাকমা বলেন, নারীরা চেষ্টা করলে পৃথিবী কাঁপিয়ে দিতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্দোলনের ক্ষেত্রেও নারীদেরকেই বৃহত্তর ভূমিকা পালন করতে হবে। নারীরা সচেতন হয়ে ঐক্যবদ্ধ হলেই এ অঞ্চলে কাঙ্খিত পরিবর্তন সম্ভব হবে তিনি মত প্রকাশ করেন।

হিল উইমেন্স ফেডারেশন নেত্রী নীতি চাকমা বলেন, সারাদেশে নারীদের উপর যে অমানুষিক সহিংসতা, পৈশাচিক নির্যাতন চলছে তা থেকে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম মুক্ত নয়। এখানে আরো বেশি ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে। নারীদের উপর এই যে অমানবিকতা চলেছে তার একমাত্র কারণ হচ্ছে আমরা নারীরা নারী শক্তিকে জাগ্রত করতে পারছি না। বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছি। তাই শাসকগোষ্ঠী আমাদের নারীদের উপর নিপীড়ন-নির্যাতন চালাতে দুঃসাহস পায়। তাই আর নয় বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকা, আমাদেরকে একত্রিত হয়ে নারী শক্তিকে জাগিয়ে তুলে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে কাজে লাগাতে হবে।

যুব ফোরাম নেতা বরুণ চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে শুধু নারী নির্যাতন নয়, সেনা-সেটলার কর্তৃক জুম্মদের ভুমি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। অব্যাহতভাবে ধরপাকড়, খুন, গুম জারি রাখা হয়েছে। বান্দরবান লামায় গত ২৬ এপ্রিল লামা রাবার ইন্ডাষ্ট্রিজ লিমিটেড নামের একটি কোম্পানি সেখানকার ম্রো ও ত্রিপুরাদের লংকম কারবারী পাড়া, রেংয়েন কার্বারী পাড়া ও জয়চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়া এলাকায় প্রায় ৩৫০ একর জুমচাষের প্রাকৃতিক বন আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। এই রাবার কোম্পানি প্রশাসনের সহযোগিতায় জোরপূর্বক জমি বেদখলের মাধ্যমে সেখান থেকে ম্রো ও ত্রিপুরা গ্রামবাসীদের উচ্ছেদের পাঁয়তারা চালাচ্ছে।  

পিসিপি নেতা মিটন চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্রগ্রামসহ সারাদেশে কর্মক্ষেত্রে নারীদের কোন নিরাপত্তা নেই। তাই এক্ষেত্রে নারীদেরকে আরো বেশি সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তিনি বলেন, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ নারী নির্যাতনসহ সকল অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যেতে দূঢ় প্রতিজ্ঞ।

দ্বিতীয় অধিবেশনে সম্মেলনে উপস্থিত সকলের সম্মতিক্রমে কণিকা দেওয়ানকে সভাপতি, পরিণীতা চাকমাকে সাধারণ সম্পাদক ও সোনাদেবী চাকমাকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে ৩৩ সদস্য বিশিষ্ট নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। ইউপিডিএফ-এর কেন্দ্রীয় সদস্য উজ্জল স্মৃতি চাকমা নতুন কমিটিকে শপথ বাক্য পাঠ করান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *