পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী-ইউপিডিএফ দ্বন্দ্ব নিয়ে কথা বলতে চান না স্থানীয় পাহাড়িরা

তপন চাকমা

পাহাড়ে সংঘাতের কারণে চাপা আতংকে থাকেন সাধারণ মানুষ।
ছবির ক্যাপশান, পাহাড়ে সংঘাতের কারণে চাপা আতংকে থাকেন সাধারণ মানুষ।

খাগড়াছড়ির দীঘিনালা বাজার। বাজার বলতে অবশ্য দুটি দোকান মাত্র। আর কিছু ফলমূল, শাক-সবজি নিয়ে দুয়েকজন বিক্রেতা।

সপ্তাহখানেক আগে এই বাজার থেকেই ৬ মাইল দূরে পাহাড়ী এলাকায় সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হয় ইউপিডিএফের তিন সদস্য।

যদিও গোলাগুলির কথা অস্বীকার করেছে ইউপিডিএফ। তারা এ ঘটনাকে বলছে ‘ঠান্ডা মাথায় হত্যাকাণ্ড’।

জায়গাটা বেশ দুর্গম। নিরাপত্তা নিয়েও সংশয় আছে।

বাজারের একজন সবজি বিক্রেতা জানান, কারা মারা গেছে কিভাবে মারা গেছে তিনি তা জানেন না।

তবে বাজারের পাশেই নাম প্রকাশ করার না করার শর্তে এক পাহাড়ি নারী জানালেন, এসব নিয়ে তারা কথা বলতে চান না।

তবে অস্ত্রধারী ব্যক্তিদের আনাগোনা সেখানে আছে বলে স্বীকার করেন তিনি।

তার বক্তব্য, “এখানে ইউপিডিএফের কে আসবে, কে যাবে সেখানে আমাদের করার কিছু নাই। এটা সরকারের ব্যাপার।”

দীঘিনালায় সেনাবাহিনীর সঙ্গে ‘গোলাগুলি”র ঘটনার পর থেকেই ইউপিডিএফের নেতারা গা ঢাকা দিয়েছেন।

ইউপিডিএফের উদ্ভব কিভাবে?

পাহাড়ে এখন চারটি আঞ্চলিক সংগঠন রয়েছে। এর মধ্যে ইউপিডিএফ শুরু থেকেই পার্বত্য শান্তি চুক্তি বিরোধী। মূলত: চুক্তির বিরোধীতা থেকেই দলটির উদ্ভব।

ইউপিডিএফের খাগড়াছড়ি জেলার সংগঠক অংগ মারমা বলছেন, চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসনের নিশ্চয়তা ছিলো না।

তিনি বলছেন, “চুক্তিতে সেনাবাহিনী কখন চলে যাবে, সেটা নির্ধারিত ছিলো না। বসতি স্থাপনকারী বাঙ্গালীরা কিভাবে, কখন যাবে এবং ভূমি সমস্যার সুনির্দিষ্ট সমাধান কীভাবে হবে তার উল্লেখ ছিলো না। এসব কারণেই আমরা চুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নেই। এবং সেসময় সচেতন যারা ছিলেন তারা মিলেই ১৯৯৮ সালে ইউপিডিএফ গঠন করা হয়।”

অংগ মারমা বলছেন, শুরু থেকেই তার ভাষায় ‘জনগনের পক্ষে’ থাকায় তারা পার্বত্য এলাকার বিভিন্ন জায়গায় শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলতে পেরেছেন।

ইউপিডিএফ(গণতান্ত্রিক) এর সভাপতি শ্যামল কান্তি চাকমা।
ছবির ক্যাপশান, ইউপিডিএফ(গণতান্ত্রিক) এর সভাপতি শ্যামল কান্তি চাকমা।

তবে এর বিপরীত মতও আছে। বলা হয়ে থাকে অস্ত্রের মাধ্যমেই পাহাড়ে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করেছে ইউপিডিএফ।

পাহাড়ে সশস্ত্র তৎপরতা আর একের পর এক প্রতিপক্ষ হত্যার মাধ্যমে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেই দলটি নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করেছে। এর সঙ্গে রয়েছে চাঁদাবাজিরও অভিযোগ।

তবে দলটির নেতারা তা অস্বীকার করলেও বলা হয় মূলতঃ এসব কারণেই প্রতিষ্ঠার বিশ বছরের মাথায় ভাঙন তৈরি হয় ইউপিডিএফে।

সশস্ত্র তৎপরতা থেকে বেরিয়ে আসার তাগিদে গঠিত হয় নতুন দল ‘ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক’।

নতুন এই দলটির সভাপতি শ্যামল কান্তি চাকমা বলছিলেন, “বেশ কিছুদিন থেকেই আমরা পার্টির নেতাদের বলছিলাম যে, পার্টি সঠিক পথে চলছে না। এখানে দলীয়করণ, আত্মীয়করণ এবং পার্টির মধ্যে সিন্ডিকেট হচ্ছে। জনগনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সেটা দিয়ে অস্ত্র কেনা হচ্ছিলো। আমরা বলছিলাম, এ পথ থেকে সরে নতুনভাবে শান্তিপূর্ণ পথে আসার জন্য। কিন্তু এসব কথা বলার কারণে তারা আমাদের শত্রু ভাবতে শুরু করে।”

তিনি বলছেন, তারা একটি অংশ দলের গোপন কার্যক্রম ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলে কয়েকজনকে হত্যাও করা হয়।

তখনি তারা নিজেদের বাঁচাতে ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক গড়ে তোলেন।

সংঘাতের কারণ কী?

২০১৭ সালের নভেম্বরে ইউপিডিএফ ভেঙ্গে নতুন দল তৈরি হওয়ার পর আধিপত্য বিস্তার নিয়ে পাহাড়ে হঠাৎ করেই খুনোখুনি বৃদ্ধি পায়। যার সূত্রপাত ইউপিডিএফ মূল দলের এক নেতার হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে।

স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো বলছে, গত দেড় বছরে পাহাড়ি সংগঠনগুলোর পাল্টাপাল্টি সংঘর্ষে ৪৫ জনের মৃত্যু ঘটেছে।

এসব সংঘর্ষ মূলতঃ হয়েছে ইউপিডিএফ বনাম ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক ও এম এন লারমাপন্থী জনসংহতি সমিতির মধ্যে।

বলা হয়, আদর্শিক কারণ নয়, মূলতঃ আধিপত্য বিস্তার, নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব আর চাঁদাবাজির মাধ্যমে বিপুল অর্থ আয়ের পথ সুগম রাখতেই দলগুলোতে ভাঙন এবং সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।

তবে ইউপিডিএফ স্পষ্টভাবেই বলছে, সংঘর্ষের কারণ সরকারের ষড়যন্ত্র। সরকার চায় পাহাড়ে ভাতৃঘাতি সংঘাত থাকুক।

অংগ মারমা বলছিলেন, “বাকি দলগুলো এখন কোন না কোনভাবে প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে, তাদের কথা শুনছে। কিন্তু আমরা শুরু থেকেই পাহাড়ী মানুষের অধিকারের সঙ্গে কোন আপোষ করি নাই। সাজেকে, আলুটিলায় সরকারের ভূমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আমরাই একমাত্র জনগনকে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলাম। এ কারণেই এখন প্রশাসন শুধু আমাদেরকেই টার্গেট করছে।”

তবে আইন-শৃংখলা বাহিনী অবশ্য ভিন্নমতই দিচ্ছে।

খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার আহমার উজ্জামান বলছেন, সশস্ত্র অবস্থান থেকে ইউপিডিএফ সরে না আসার কারণেই সংঘাত ঘটছে।

“রাজনীতি আর সশস্ত্র অবস্থান বা সামরিক শাখা একসঙ্গে চলতে পারে না। যেহেতু তারা অস্ত্র ব্যবহার করে, মানুষকে জিম্মী করে, সেহেতু তাদের সঙ্গে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। তাদেরকে অবশ্যই অস্ত্রের পথ ত্যাগ করতে হবে।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *