আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের আলোচনা সভা

বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আজ (২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০) শুক্রবার দুপুর আড়াইটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার মিলনাতনে আলোচনা সভা করেছে।

‘সকল মাতৃভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি চাই’ এই শ্লোগানে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি বিপুল চাকমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় আলোচনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. আকমল হোসেন, একই বিভাগের শিক্ষক তানজিম উদ্দিন খান, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সম্পাদক ফয়জুল হাকিম ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক থুইক্যচিং মারমা।
এছাড়া সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন লেখক শিবিরের সাধারণ সম্পাদক কাজী ইকবাল, ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি পারভেজ লেলিন, বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলনের সভাপতি আতিক অনিক।
সভা পরিচালনা করেন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সুনয়ন চাকমা।
আলোচনা সভা শুরুতে পিসিপির সাধারণ সম্পাদক সুনয়ন চাকমার রচিত প্রবন্ধ পাঠ করেন একই সংগঠনের কেন্দ্রীয় সদস্য রূপসী চাকমা।

সভায় অধ্যাপক আকমল হোসেন বলেন, ভাষা বিষয়টি  জটিল ও স্পর্শকাতর। ভাষা ও সংস্কৃতির মাধ্যমে একটি জাতি টিকে থাকে। ভাষা আন্দোলনের সময় বাঙালি হওয়া সত্ত্বেও অনেকে বিশেষ করে মুসলীম লীগ নেতাকর্মীরা মুসলমানের ভাষা হিসেবে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ব্যবহারের পক্ষে ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের পর বাংলা রাষ্ট্রভাষা স্বীকৃতি পাওয়া সত্ত্বেও ভাষা নিয়ে বিতর্ক থেমে থাকেনি। কেউ কেউ নিজেদের মুসলমান জাতি হিসেবে মনে করত, ফলে তারা মুসলিমদের ভাষা হিসেবে উর্দুকে ব্যবহারের পক্ষপাতি ছিলেন। পাকিস্তান সময়ে  বাংলা ও উর্দু রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃত হলেও দাপ্তরিক ভাষায় কখনো বাংলা ও উর্দু ব্যবহৃত হয়নি, তার বদলে ব্যবহৃত হয়েছিল ইংরেজি। এ থেকে এটা বোঝা যায়, ঔপনিবেশিক চিন্তা চেতনার মধ্য দিয়ে ভাষার বিষয়টি ছিল। এখনো সেই চিন্তাধারা চলছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

তিনি বলেন, ঔপনিবেশিক চেতনার বিশ্বাসী বলে শাসকগোষ্ঠী এখনো বাঙালি ভিন্ন অন্য জাতিসত্তাদের অস্তিত্ব ও তাদের ভাষাকে স্বীকৃতি দিচ্ছে না। ঔপনিবেশিক চিন্তা চেতনার কারণে  অন্যভাষা ও জাতিসমূহকে ভূলেই যাওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ এক জাতি, এক ভাষা, এক ধর্মের রাষ্ট্র-এমন মনোভাব বিদ্যমান রয়েছে। এ কারণে ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। শাসকগোষ্ঠী সংখ্যালঘু জাতিসত্তাসমূহকে স্বীকৃতি না দিয়ে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী  হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এই অভিধা গ্রহণ যোগ্য নয় এবং এর মাধ্যমে বৈচিত্রের ব্যাপারটি বোঝানো যায় না।

তিনি আরো বলেন, ভাষার মাধ্যমে মানুষ তার নিজের পরিচয় বহন করে। ভাষার সাথে সংস্কৃতির সমন্বয় না থাকলে উন্নত জাতি হিসেবে গড়ে ওঠা সম্ভব হয়না।
তিনি প্রশ্ন করে বলেন, বাঙালি সংগ্রামী বীরদের পাঠ্য-পুস্তকে স্থান থাকতে পারলে অন্য জাতিসত্তাদের বীরদের কেন থাকবে না?
জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিম বলেন, বাংলাদেশ বহুজাতিক দেশ। বাঙালি ভিন্ন বহু জাতিসত্তা রয়েছে এদেশে। তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ভাষা রয়েছে। এ সমস্ত জাতিসত্তাসমূহ সম্পর্কে এদেশের শাসকগোষ্ঠী জানাশুনা কম। পাকিস্তান সময়ে জাতিগত নিপীড়ন ও মাতৃভাষার  অধিকারের জন্য সংগ্রাম হয়েছিল। ভাষার মাধ্যমে এদেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল এবং রাজনৈতিক সংগ্রাম গড়ে ওঠেছিল। এ থেকে এটা বলা যায়, ভাষা সংগ্রামের সাথে রাজনৈতিক সংগ্রামের সম্পর্ক ছিল। জাতিসত্তাসমূহের ভাষা সংস্কৃতির  আন্দোলনও রাজনৈতিক সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, এ আন্দোলন সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। 

তিনি বলেন, ভাষাগত সংখ্যালঘু ও নৃতাত্ত্বিকভাবে ভিন্ন জাতিসত্তাসমূহের সাংবিধানিক স্বীকৃতি নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি-বাঙালি দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে শাসকগোষ্ঠী ফায়দা নিচ্ছে। সেখানে শুধু ভাষা নয় সামগ্রিক বিষয়ে আগ্রাসন চলছে। উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সকলে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তানজিম উদ্দিন খান বলেন, বাংলাদেশে জগাখিচুড়ি রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিদ্যমান রয়েছে। সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাঙালী জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই সংশোধনীর মাধ্যমে এটা বোঝানো হয়েছে যে, এদেশে অন্য জাতির কোন অস্তিত্ব নেই। এ থেকে বোঝা যায় রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গী। রাষ্ট্র সবাইকে ধারণ করতে পারছেনা। তিনি বলেন, জাতিসত্তাসমূহ ভাষার উপর নির্ভর। গত একশ বছরে  ১০টি ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

তিনি আরও বলেন, জাতিসত্তাসমূহের ভাষা বাংলার সাথে সংগ্রামে রত অন্যদিকে বাংলাও ইংরেজি ভাষার সাথে সংগ্রাম করছে। জাতিসত্তাসমূহের ভাষা প্রতিষ্ঠানগত পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। তিনি বলেন, জাতিসত্তার মাতৃভাষার শিক্ষা শুরু করা হলেও তা দায়সাড়া গোছের। শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে না।
থুইক্যচিং মারমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক জায়গা নাম বিকৃত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে পরিকল্পিতভাবে জায়গার নাম পরিবর্তন কিংবা বিকৃত করা হচ্ছে। এটা একপ্রকার সাংস্কৃতিক আগ্রাসন হিসেবে তিনি অভিহিত করেন।
পাহাড়ি  ছাত্র পরিষদের সভাপতি বিপুল চাকমা বলেন, খুবই দুঃখের সাথে বলতে হয়, যে দেশে ভাষার জন্য সংগ্রাম হয়েছে, সে দেশে সংখ্যালঘু জাতিস্তাসমূহের মাতৃভাষা শিক্ষা পূর্ণাঙ্গরূপে চালু হয়নি। 
তিনি বলেন, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের আন্দোলন ও সমালোচনার কারণে সরকার মাতৃভাষার শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করলেও তা নামমাত্র। অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বই পর্যন্ত পাচ্ছেনা শিশুরা। এসমস্ত বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রশিক্ষিত না হওয়ার কারণে শিশুদের পড়াতেও সক্ষম হচ্ছে না।
তিনি বলেন, পাঠ্যপুস্তকে এখনো অবমাননাকর বিষয়সমূহ রয়েছে। শাসকগোষ্ঠী চাপিয়ে দেয়া ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠীও একটি অবমাননাকর শব্দ। তিনি অভিযোগ করে বলেন, বিতর্কিত ও দুর্নীতিগ্রস্ত জেলাপরিষদের মাধ্যমে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়োগ দিয়ে সেখানকার শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হচ্ছে।
আলোচনা সভায় পঠিত প্রবন্ধে সরকারের প্রতি নিন্মোক্ত ৮ দফা সুপারিশ উত্থাপন করা হয়ঃ
১.সংখ্যালঘু জাতিসত্তার ভাষাগুলোর গবেষণা, চর্চা, বিকাশ ও সংরক্ষণে পৃথক ‘সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ভাষা একাডেমি’ প্রতিষ্ঠা করা।২. আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে দেশের অন্যান্য ভাষাসমূহের উন্নতি ও বিকাশে প্রয়োজনীয় জনবল, বাজেট ও গবেষণা প্রকল্প গ্রহণ করা।৩. মাতৃভাষায় পাঠ্যবই রচনার ক্ষেত্রে স্ব স্ব জাতিসত্তার অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করা এবং শিক্ষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেয়া।৪. ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন-২০১০ সংস্কারপূর্বক দেশে বিদ্যামান ৮টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটকে ঢেলে সাজানো, ইনস্টিটিউটসমূহে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়োগদান, ভাষা-সংস্কৃতি বিকাশে অধ্যয়ন-গবেষণা কর্মের জন্য প্রয়োজনীয় বৃত্তি প্রদান, জাতিসত্তা অধ্যুষিত অঞ্চলে ইনস্টিটিউটের সংখ্যা বৃদ্ধি ও বাজেট বরাদ্দ দেয়া।৫. সংখ্যালঘু জাতিসমূহের ভাষা ও সাহিত্য বিকাশের জন্য বিশ্বের অগ্রসর দেশসমূহের অভিজ্ঞ ভাষাবিজ্ঞানীদের আমন্ত্রণ জানানো, আলোচনা, সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করা এবং চুক্তি ভিত্তিতে তাদের নিয়োজিত করা যায় কিনা বিবেচনা করা।৬. পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সংখ্যালঘু জাতিসত্তা অধ্যুষিত অঞ্চলের রাস্তাঘাটের সাইনপোস্টে ইংরেজি-বাংলার পাশাপাশি তাদের ভাষা ও বর্ণ ব্যবহার করা।৭. বাংলাদেশ বেতার রাঙামাটি কেন্দ্রকে পূর্ণাঙ্গ বেতার কেন্দ্রে রুপান্তরিত করা এবং সম্প্রচারের সময় বৃদ্ধি করে দৈনিক কমপক্ষে ৮-১০ ঘন্টা সংখ্যালঘু ভাষাভাষীদের অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা। খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানেও পৃথক বেতার কেন্দ্র স্থাপন করা যেতে পারে।৮. সরকারি চাকুরির সকল স্তরে পিছিয়ে পড়া সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল করা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *