বিশ্ব মানবাধিকার দিবস ও পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতি

আজ ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। এ লক্ষ্যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। ১৯৫০ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে এ দিবসটি পালিত হচ্ছে।

দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ’বৈষম্য ঘোচাও, সাম্য বাড়াও, মানবাধিকারের সুরক্ষা দাও’।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত ৩০টি ধারা সম্বলিত সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ৫ নং ধারায় বলা হয়েছে- ‘কারো প্রতি নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা অবমাননাকর আচরণ করা কিম্বা কাউকে নির্যাতন করা বা শাস্তি ভোগ করতে বাধ্য করা চলবে না’;  ৯ নং ধারায় বলা হয়েছে- ‘কাউকে খেয়াল খুশীমত গ্রেফতার বা আটক করা অথবা নির্বাসন দেয়া যাবে না;  ১৫ নং ধারায় বলা হয়, ‘প্রত্যেকেরই একটি জাতীয়তার অধিকার রয়েছে। কাউকেই যথেচ্ছভাবে তার জাতীয়তা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না’; ২০ নং ধারায় বলা হয়েছে- ‘প্রত্যেকেরই শান্তিপূর্ণভাবে সম্মিলিত হবার অধিকার রয়েছে’।

৭৩ বছর আগে এই সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র গৃহীত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে এর কার্যকর কোন প্রভাব নেই।  শাসকশ্রেণী কর্তৃক যুগ যুগ ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে চালানো হচ্ছে পাহাড়ি জনগণের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতনের স্টিম রোলার। সংঘটিত করা হয়েছে ডজনের অধিক গণহত্যাসহ অসংখ্য সাম্প্রদায়িক হামলা। রাষ্ট্রের নিয়োজিত বাহিনী-সংস্থাগুলো প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সংঘটিত করেই যাচ্ছে।

শান্তির বাণী শুনিয়ে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও নিপীড়ন-নির্যাতন, হামলা, ভূমি বেদখল, নারী নির্যাতন আগের মতোই অব্যাহত রয়েছে। বলা যায়, চুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে।

মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে ‘কাউকে খেয়াল খুশীমত গ্রেফতার বা আটক করা অথবা নির্বাসন দেয়া যাবে না’ এমন কথা উল্লেখ থাকলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে  সেনা শাসন ‘অপারেশন’ উত্তরণ জারি রেখে এর মাধ্যমে সেনাবাহিনী যত্রতত্রভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে যাচ্ছে। ইচ্ছে হলেই যে ‘কাউকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার, নির্যাতন, হয়রানি, খবরদারি-নজরদারি, হাতে অস্ত্র গুঁজে দিয়ে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে জেল হাজতে প্রেরণ, বিচার বহির্ভুত হত্যাসহ নানা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটেই চলেছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে এ বছর জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ১৩৭ জন বিনা কারণে গ্রেফতারের শিকার হয়েছেন।

‘প্রত্যেকেরই একটি জাতীয়তার অধিকার রয়েছে। কাউকেই যথেচ্ছভাবে তার জাতীয়তা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না’ বলে মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে বলা হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত পাহাড়ি জাতিগুলোকে নিজস্ব জাতীয়তার অধিকার থেকেও বঞ্চিত করার অপচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ’৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানে যেভাবে উগ্র বাঙালি জাতীয়তা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, একইভাবে ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমেও বাঙালি জাতীয়তা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা এখনো সংবিধানে বহাল রয়েছে।

মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে শান্তিপূর্ণভাবে সকলের সম্মিলিত হবার অধিকারের কথা বলা হয়েছে। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক মিছিল-মিটিং ও সভা-সমাবেশ আয়োজনে প্রায়ই বাধা-নিষেধ আরোপ করা হয়ে থাকে। অগণতান্ত্রিক ১১ নির্দেশনা জারির মাধ্যমে মানুষের মত প্রকাশের অধিকার সংকুচিত করা হয়েছে।

অন্যদিকে, গত ২৯ আগস্ট ২০২১ সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় জুম চাষ ও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে হলুদ-আদা চাষ সীমিত করার ব্যাপারে কঠোর নজরদারী বৃদ্ধি করতে এবং নিরুৎসাহিত করতে আশু পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব এর কাছে এ নির্দেশনা প্রেরণ করা হয়েছে। যা পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী।

তাই বিশ্ব মানবাধিকার দিবসটির মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে বাংলাদেশ সরকার তথা রাষ্ট্রের উচিত জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র মেনে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিপীড়ন-নির্যাতনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করা এবং সুষ্ঠূ গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করা।

আর জনগণের করণীয় হলো পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, অন্যায়-অবিচার ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে অধিকতর সোচ্চার হওয়া।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *