সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের দাবিতে বিভিন্ন জায়গায় ইউপিডিএফের সমাবেশ

সংবিধানের বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল ও দেশের সকল জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির বিভিন্ন জায়গায় সমাবেশ করেছে ইউনাইটেড পিপল্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)।

আজ ৩০ জুন ২০২০, মঙ্গলবার পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পাশের ৯ বছর উপলক্ষে ইউপিডিএফের স্থানীয় ইউনিটসমূহ এ কর্মসূচির আয়োজন করে।
খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা :‘বাংলাদেশ এক জাতির দেশ নয়, বহুজাতির জাতির দেশ; সকল জাতিসত্তার স্বীকৃতি চাই’ এই শ্লোগানে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার পেরাছড়া ও ভাইবোনছড়ায় পৃথক পৃথকভাবে ইউপিডিএফের খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা ইউনিটের উদ্যোগে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
সকাল ১০টার দিকে পেরাছড়া এলাকায় অনুষ্ঠিত সমাবেশে ইউপিডিএফ সংগঠক প্রকাশ চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন, ইউপিডিএফ জেলা ইউনিটের সংগঠক অংগ্য মারমা ও সুদত্ত ত্রিপুরা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের জেলা আহ্বায়ক এন্টি চাকমা ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের জেলা অর্থ সম্পাদক নরেশ ত্রিপুরা।এছাড়া উক্ত সমাবেশে পেরাছড়া ইউনিয়নের মেম্বার নরেশ চাকমা, সোনামনি চাকমা, সরলাল ত্রিপুরা, জোৎস্না কান্তি ত্রিপুরা এবং বিভিন্ন এলাকার পাড়া কার্বারীবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

অপরদিকে ভাইবোন ছড়া এলাকায় অনুষ্ঠিত সমাবেশে গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের জেলা শাখার দপ্তর সম্পাদক লিটন চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন ইউপিডিএফের কেন্দ্রীয় সদস্য দেবদন্ত ত্রিপুরা, উপজেলা সংগঠক পার্বণ চাকমা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সমর চাকমা, ৫নং ভাইবোনছড়া ইউপি’র ৪নং ওয়ার্ড সদস্য মতেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, কার্বারী এসোসিয়েশনের নেতা কুসুম মনি চাকমা, মনিগ্রামের কার্বারী সোনাত্তন চাকমা ও এলাকার যুব সমাজের প্রতিনিধি সোনামনি চাকমা প্রমুখ।
পৃথকভাবে অনুষ্ঠিত এসব সমাবেশে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশ এক জাতির দেশ নয়, বহুজাতির দেশ। বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়াও ৪৫টির আধিক জাতিসত্তার বসবাস রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সমতলের সংখ্যালঘু জাতিসত্তার জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালি নয়। তাদের নিজ নিজ জাতিগত পরিচয়, ভাষা, ধর্ম ও ঐতিহ্য-সংস্কৃতি রয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে পাহাড়ি জাতিসত্তার জনগণ তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির জন্য লড়াই করে আসছে ।
বক্তারা আরো বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের ৪৫টির অধিক জাতিসত্তার জনগণকে নিজ নিজ জাতিগত পরিচয় মুছে দিতে পঞ্চদশ সংশোধনী প্রবর্তন করেছে। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে প্রতিবাদের মুখে পাহাড়ি জনগণকে বাঙালি বানাতে সক্ষম না হওয়ায় শেখ হাসিনার সরকার ২০১১ সালে ২য় দফায় এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের তিন এমপি সংসদে টেবিল চাপড়িয়ে বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী বিলে সমর্থন দিলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের আপামর জনগণ এটা মেনে নেয়নি এবং কখনো মেনে নেবে না।

বক্তারা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করে দেশের সকল জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে বলেন, সরকার যদি বিতর্কিত এই সংশোধনী বাতিল না করে জাতিসত্তার আত্মপরিচয় মুছে ফেলতে তৎপর থাকে তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও দেশে বসবসারত জাতিসত্তার জনগণ এর বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে পিছপা হবে না।
নেতৃবৃন্দ সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর প্রবর্তন ও বর্তমানে পাহাড়ি জনগণের উপর চলমান দমনপীড়ন একই সূত্রে গাঁথা মন্তব্য করে বলেন, উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারক বাহক আওয়ামী লীগ বাহ্যিকভাবে সংখ্যালঘুদের প্রতি প্রেমভাব দেখালেও, অন্তরের গভীরে তারা এক জাতিরাষ্ট্রে বিশ্বাসী এবং বাস্তবে তারা দেশের অন্যান্য জাতির জাতীয় অস্তিত্ব মুছে ফেলে দিতে তৎপর রয়েছে।
সে কারণে দেখা যায় আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীরা এক সময় ‘আদিবাসী’ শব্দটি উচ্চারণ করে তাদের প্রতি মায়াকান্না করলেও যখন জাতিসংঘে আন্তর্জাতিক আদিবাসী সনদ পাশ করা হয় তখন থেকে তারা ভুলেও এই শব্দটি আর মুখে আনেনি।
বক্তারা আওয়ামী লীগ সরকারকে দ্বিচারিতা পরিহার করে সংবিধানে সংখ্যালঘু জাতিগুলোকে স্বীকৃতি প্রদানপূর্বক তাদের ন্যায্য অধিকার ও পাওনা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।
পানছড়ি :একই দাবিতে আজ সকাল ১১টায় জেলার পানছড়ি উপজেলার লোগাং ইউনিয়নে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে ইউপিডিএফ সংগঠক সাইক্লোন চাকমার সভাপতিত্বে ও সুর মঙ্গল চাকমার সঞ্চলনায় বক্তব্য রাখেন, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের খাগড়াছড়ি জেলা সাংগঠনিক সম্পাদক নিকেল চাকমা ও পানছড়ি ইউপি সদস্য সঞ্চয় চাকমা প্রমুখ।

বক্তারা বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হওয়ার পর থেকে পাহাড়ি জাতিগুলোকে নিশ্চিহ্ন করতে তাদের উপর দমনপীড়ন জোরদার করা হয়েছে। এখন যারা জনগণের পক্ষে কথা বলতে চাইছে তাদেরকে খুন, গুম, গ্রেফতার  করা হচ্ছে।
কোন ধরনের দমন-পীড়ন জুম্ম জনগণের আন্দোলনকে স্তব্ধ করা যাবে না মন্তব্য করে নেতৃবৃন্দ অবিলম্বে এই বিতর্কিত সংশোধনী বাতিল করে সকল জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি জানান।
মানিকছড়ি :দুপুর ১২টার দিকে খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে অনুষ্ঠিত সমাবেশে ইউপিডিএফ সংগঠক এডিশন চাকমা সভাপতিত্ব করেন। বক্তব্য রাখেন ইউপিডিএফ সংগঠক চিনু মারমা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক অমিত চাকমা ও মানিকছড়ি উপজেলা শাখার সভাপতি অংসালা মারমা।
বক্তারা অবিলম্বে বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করে দেশের সকল জাতিসত্তাগুলোকে সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি করেন।

রামগড় :আজ দুপুর সাড়ে ১২টার সময় রামগড়ে একই দাবিতে স্থানীয় ইউপিডিএফ ইউনিটের উদ্যোগে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে সাবাগ চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন ইউপিডএফ রামগড় উপজেলা ইউনিটের সংগঠক দবন চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের খাগড়াছড়ি জেলা কমিটির সদস্য শুভ চাকমা, রামগড় উপজেলা শাখার সভাপতি সুরেশ চাকমা ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের রামগড় উপজেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক বাহাদূর ত্রিপুরা।
বক্তারা বলেন, বাঙালি জনগণের ওপর পাকিস্তানের জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করে যে দেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে সে দেশের সরকার কীভাবে তার দেশে বসবাসরত ভিন্ন ভাষাভাষী জাতিসত্তাগুলোর ওপর বাঙালি জাতীয়তা চাপিয়ে দিতে পারে?

সমাবেশ থেকে বক্তারা জাতিসত্তার অবমাননাকর বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল, পাহাড় ও সমতলে বসবাসরত সকল জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি, পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান অঘোষিত সেনা শাসন প্রত্যাহার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অগণতান্ত্রিক ১১ নির্দেশনা বাতিল করা ও অন্যায় গ্রেফতার-নির্যাতনসহ দমন-পীড়ন বন্ধের দাবি জানান।
কুদুকছড়ি (রাঙামাটি) :রাঙামাটির কুদুকছড়িতেও একই দাবিতে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সকাল সাড়ে ১০টায় অনুষ্ঠিত সমাবেশে ইউপিডিএফ সদস্য সাজেক চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন ইউপিডিএফ সংগঠক তাপু চাকমা ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের রাঙামাটি জেলা শাখার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নিকন চাকমা প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে বসবাসরত ৪৫টির অধিক জাতিসত্তার ওপর অবমাননাকর বাঙালি জাতীয়তা চাপিয়ে দিয়ে কার্যত এসব জাতিসত্তার জনগণকে অস্বীকার করা হয়েছে। এই সংশোধনীর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের সাম্প্রদায়িকতা ও জাতি-বিদ্বেষী মনোভাব ফুটে উঠেছে।

বক্তারা অভিযোগ করে আরো বলেন, বর্তমান সরকার জনগণের বাকস্বাধীনতা হরণ করাসহ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে গলাটিপে হত্যার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।  বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলনরত ইউপিডিএফ’র নেতাকর্মি ও সমর্থকদের মিথ্যা বানোয়াট মামলায় আটক ও বিনা বিচারে হত্যাসহ নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। এছাড়াও  একটি ঠ্যাঙারে বাহিনীকে প্রত্যক্ষ মদদ দিয়ে খুন-গুম, অপহরণসহ নানা সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
বক্তারা গণবিরোধী এই পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করে সকল জাতিসত্তার স্বীকৃতি ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করাসহ পূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করার দাবি জানান।
এছাড়া খাগড়াছড়ি জেলার লক্ষ্মীছড়িতেও একই দাবিতে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। 
খবর প্রেস বিজ্ঞপ্তি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *