বান্দরবানে ম্রোদের জমি দখল করে হোটেল নির্মাণ বন্ধের দাবিতে চট্টগ্রামে সংহতি সমাবেশ

বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ে ম্রো সম্প্রদায়ের ১০০০ একর জমি বেদখল করে সিকদার গ্রুপ কর্তৃক পাঁচ তারকা হোটেল ম্যারিয়ট ও এমিউজম্যান্ট পার্ক নির্মাণ উদ্যোগের প্রতিবাদে এবং অবিলম্বে নির্মাণ কাজ বন্ধের দাবিতে চট্টগ্রামে সংহতি সমাবেশ করেছে চার পাহাড়ি সংগঠন।

“উন্নয়নের নামে পাহাড়ে ভূমি বেদখল ও উচ্ছেদ বন্ধ কর” এই শ্লোগানে আজ শুক্রবার (১৩ নভেম্বর ২০২০) বিকাল সাড়ে ৩টায় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি), গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন যৌথভাবে নগরীর চেরাগী পাহাড় মোড়ে এ সংহতি সমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশের পূর্বে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়।

বিক্ষোভ মিছিল চলাকালে নেতাকর্মীরা ‘Stop evicting Mro community from their inherited ancestral jhum land in the name of constructing five star hotel by Sikder group”, “উন্নয়নের নামে পাহাড়ে ভূমি বেদখল ও উচ্ছেদ বন্ধ কর”, “Stop land grabbing in Banderban in the name of constructing 5 star hotel”,  ” পাহাড়িদের প্রথাগত ভূমি অধিকার মেনে নাও” সহ বিভিন্ন দাবিনামা সম্বলিত প্লাকার্ড বহন করে।

যুব নেতা উচিংশৈ চাক(শুভ)-এর সভাপতিত্বে পিসিপি’র নগর শাখার সাধারণ সম্পাদক অমিত চাকমার সঞ্চালনায় মিছিল পরবর্তী অনুষ্ঠিত সংহতি সমাবেশে বক্তব্য রাখেন, পিসিপি চবি শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক মিটন চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের নগর শাখার সহ-সভাপতি পিংকি চাকমা, বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক, ডাঃ মাহফুজুর রহমান, বাসদ (মার্কসবাদী) নেত্রী আসমা আক্তার, বাসদ(পাঠচক্র) নেতা অপু দাশ গুপ্ত, গণসংহতি আন্দোলন-এর সমন্বয়ক হাসান মারুফ রুমি, প্রগতিশীল চিকিৎসক ডাঃ সুশান্ত বড়ুয়া, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন-এর সাবেক কাউন্সিলর জান্নাতুল ফেরদৌস পপি. জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল(পূর্ব -৩) চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি এডভোকেট ভূলন ভৌমিক।

এতে আরো সংহতি জানান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক মাইদুল ইসলাম, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক সুবর্ণা মজুমদার এবং বিশিষ্ট কবি ও সাংবাদিক হাফিজ রশিদ খান প্রমুখ।

বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি  ডাঃ মাহফুজুর রহমান বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামে ‘আদিবাসীদের’ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আদর্শকে সামনে রেখে পাহাড়িদের ভূমি দখল নয়, পাহাড়িদের নিজস্ব অধিকার দিতে হবে এবং চিম্বুক পাহাড়ের অবিলম্বে পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণ ও ম্রো উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র বন্ধ করতে হবে।

জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল পূর্ব-৩’র সভাপতি এডভোকেট ভুলন ভৌমিক বলেন, বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ে পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণ কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগণকে নিশ্চিহ্ন করার গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। এই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে অসামাজিক কার্যকলাপে পাহাড়ি নারীদেরকে পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে বলে তিনি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

গণসংহতি আন্দোলন চট্টগ্রাম অঞ্চলের নেতা হাসান মারুফ রুমি বলেন, বর্তমান আমেরিকায় যেভাবে আদি জনগোষ্ঠীদের উচ্ছেদ করে আধুনিক পূঁজিবাদী সমাজ গড়ে তোলা হয়েছে, ঠিক একইভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জাতিসত্তাদের নিজ ভূমি থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা হচ্ছে।

প্রগতিশীল চিকিৎসক ফোরামের নেতা ডাঃ সুশান্ত বড়ুয়া বলেন, চিম্বুক পাহাড় হচ্ছে ম্রো- জাতিসত্তাদের এবং ম্রোরা চিম্বুক পাহাড় রক্ষার্থে যে আন্দোলন সূচনা করেছে সেই আন্দোলনের সাথে পূর্ণ সংহতি জানাচ্ছি।

তিনি আরো বলেন, চিম্বুক পাহাড়ে হোটেল নির্মাণ প্রকল্পে সিকদার গ্রুপের সাথে সেনা কল্যাণ সংস্থা তথা সেনাবাহিনী যুক্ত রয়েছে। সেখানে সবচেয়ে দুর্বল জনগোষ্ঠী, সেখানকার ভূমিপুত্র ম্রোদের উচ্ছেদ করতে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা প্রয়োগ করা হচ্ছে।  কেন ম্রোদের উচ্ছেদ করে হোটেল নির্মাণ করতে হবে? এটা হতে পারে না, এটা আমরা হতে দেবো না।

তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, সেনাবাহিনীর দায়িত্ব হচ্ছে দেশকে রক্ষা করা, দুর্যোগ সময়ে জনগণের পাশে থাকা। কেন সেনাবাহিনী হোটেল ব্যবসা, কন্ট্রাক্টরি করবে?

তিনি হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, চিম্বুক পাহাড়ে পাঁচতারকা হোটেল নির্মাণের মাধ্যমে যদি ম্রোদের ভূমি দখল করা হয়, তাদের উচ্ছেদ করা হয়, তাহলে ম্রো জনগোষ্ঠীসহ সমতলের সকল পেশাজীবী মানুষ মিলে জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। হোটেল নির্মাণ বন্ধ ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন-এর সাবেক কাউন্সিলর জান্নাতুল ফেরদৌস পপি বলেন, যে সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের দেশের প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রী পরিষদের সদস্যরা বিদেশে গিয়ে পরিবেশ রক্ষার শপথ নেয়, সেই সময়ে চিম্বুক পাহাড়ে পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণ কি সরকারের টালবাহানা নয়? তিনি অবিলম্বে পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণ ওএ্যামিউজমেন্ট পার্ক বন্ধ করার জোর দাবি জানান।

অপু দাশ গুপ্ত বলেন, পাহাড় ও সমতলসহ সরকার সারাদেশে ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করেছে। যার ক্ষমতাবলে সরকার চিম্বুক পাহাড়ে পর্যটনের নামে ম্রো জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করছে। তিনি বলেন, ম্রোরা নিজ নিজ জমিতে শান্তিতে থাকতে চায়। কিন্তু পর্যটনের নামে ইতোমধ্যে তাদের শত শত একর জমি বেদখল করা হয়েছে, পাঁচতারকা হোটেল নির্মাণের নামে আরো জমি দখলের প্রক্রিয়া চালাচ্ছে।

আসমা আক্তার বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত সরকারের উন্নয়নের গল্প শুনি। কিন্তু মানুষকে উচ্ছেদ করে এটা কিসের উন্নয়ন? কার জন্য উন্নয়ন?

অন্যান্য বক্তারা বলেন, দেশে-বিদেশে বিতর্কিত সিকদার গ্রুপের সাথে মিলে সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ অবৈধভাবে ম্রো সম্প্রদায়ের বংশপরম্পরায় ভোগ করে আসা আরো ১০০০ একর জমি বেদখল করে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান পাঁচ তারকা হোটেল ম্যারিয়ট ও এমিউজমেন্ট পার্ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। তারই অংশ হিসেবে ঐ এলাকায় বিভিন্ন স্থানে সাইনবোর্ডও টাঙিয়ে দিয়েছে, যা সম্পূর্ণ অবৈধ।

তারা অবিলম্বে চিম্বুক পাহাড়ে পাঁচতারকা হোটেল-পর্যটন স্থাপনা নির্মাণ প্রকল্প বাতিল করে ম্রোদের উচ্ছেদ বন্ধ করা ও ম্রোদের জমি ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *