নিজস্ব প্রতিনিধি।। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচারবহির্ভূত হত্যা, অস্ত্র উদ্ধারের নামে অবৈধ আটক ও জামিনে মুক্তির পর জেলগেট থেকে পুনরায় আটক বন্ধের দাবিতে এবং মহালছড়িতে ৩৭ টি জুম্ম ঘরে অগ্নিসংযোগকারীদের গ্রেপ্তার ও লামার সরই ইউনিয়নে ত্রিপুরা ও ম্রোদের ৪০০ একর ভূমি জবরদখল চেষ্টার প্রতিবাদে চট্টগ্রাম নগরীতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে পাহাড়ের তিন গণসংগঠন গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম, হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ চট্টগ্রাম মহানগর ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।
মানববন্ধন থেকে মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রতিনিধিদলকে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশের অনুমতি প্রদানের দাবি জানানো হয়েছে। ব্যানারে তারা লেখেন “Allow U.N Human rights team to visit CHT.”
আজ শনিবার (১৩ আগস্ট ২০২২) বিকাল সাড়ে ৩টায় চট্টগ্রাম নগরীর কদম মোবারক থেকে মিছিল সহকারে প্রেসক্লাব এলাকা প্রদক্ষিণ করে চেরাগি মোড়ে উক্ত মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় তারা বিভিন্ন দাবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন।
মানববন্ধনে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নগর সম্পাদক অমিত চাকমার সঞ্চালনায় ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শুভ চাকের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের প্রতিনিধি দয়া সোনা চাকমা ও পিসিপি চবি শাখার সভাপতি মিটন চাকমা প্রমুখ।
বক্তারা পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের তীব্র প্রতিবাদ জানান। তারা বলেন, আগামী ১৪ আগস্ট থেকে ১৮ আগস্ট পর্যন্ত জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট-এর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করবেন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার উক্ত প্রতিনিধিদলকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সফরের অনুমতি দেয়নি বলে জানা গেছে। ফলে প্রতিনিধিদলটি সেখানে মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে যেতে পারবে না। বক্তারা সরকারের এ সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেন এবং জাতিসংঘের প্রতিনিধিদলকে পার্বত্য চট্টগ্রাম সফরের অনুমতি দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
বক্তারা আরো বলেন, সরকার রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার নিকৃষ্ট বাসনায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রতিনিধি দলকে সেখানে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। এতেই প্রমাণ হয় পার্বত্যাঞ্চলে সরকার ও তার নিয়োজিত বাহিনী কর্তৃক কী নিষ্ঠুর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে।
মানববন্ধনে দয়া সোনা চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচার বহির্ভূত হত্যা, খুন, গুম, অপহরণসহ মানবাধিকার লঙ্ঘন অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, ইউপিডিএফ ও সহযোগী সংগঠনের ওপর অব্যাহত দমন-পীড়ন চলছে বলে অভিযোগ করেন। তিনি গ্রেফতারকৃত সকল নেতা-কর্মীকে নিঃশর্ত মুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসন অপরেশন উত্তরণ তুলে নেয়া এবং অস্থায়ী সকল সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহারপূর্বক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা, বহিরাগত বাঙালি সেটলারদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সমতলে সম্মানজনক পুনর্বাসন, নারী নির্যাতন বন্ধ, সেনা মদদে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ করে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং দেশের সংখ্যালঘু জনগণের ওপর হামলা, নিপীড়ন বন্ধের দাবি জানান।
মিটন চাকমা বলেন, এ বছর বহিরাগত বাঙালি সেটলারদের দ্বারা ৫টি সাম্প্রদায়িক হামলা ও ১১টি ভূমি বেদখলের ঘটনা ঘটেছে। ভূমি বেদখলের ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম দু’টি ঘটনা হলো বান্দরবানে লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামক কোম্পানি কর্তৃক সেখানকার ম্রো ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীদের ভোগদখলীয় ৪০০ একর জুমের জমি বেদখল করতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে জমি, জুমখেত ও বাগান পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। উক্ত জমি বেদখলের চেষ্টা এখনো অব্যাহত রয়েছে। গত ১০ আগস্ট কোম্পানির লেলিয়ে দেওয়া দুর্বৃত্তরা সেখানকার রেংইয়েন ম্রো পাড়ায় নবনির্মিত অশোক বৌদ্ধ বিহারে হামলা-ভাংচুর ও বুদ্ধমূর্তি লুট করে নিয়ে গেছে। অপরদিকে গত ৫ জুলাই খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ি উপজেলার মাইসছড়ি ইউনিয়নের জয়সেন পাড়ায় বহিরাগত বাঙালি সেটলাররা ভূমি বেদখলের উদ্দেশ্যে পাহাড়িদের ৩৭টি ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর ও লুটপাট চালায়। এতে পাহাড়িরা ভূমি হারানোর আতঙ্কে দিনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন।
সভাপতির বক্তব্যে শুভ চাক বলেন, ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের নিপীড়ন-নির্যাতন থেকে কেউ আর মুক্ত নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে নিপীড়নে যুক্ত রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সদস্যদের বিচার না হওয়ার কারণে সমতলেও খুন, গুম, অপহরণসহ সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে। তিনি দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার-নিপীড়নসহ সমতলের বিভিন্ন এলাকায় বসবাসরত ভিন্ন ভাষাভাষী জাতিগুলোর ওপরও নানা নিপীড়ন ও ভূমি থেকে উচ্ছেদ করার পাঁয়তারা চলছে বলে অভিযোগ করেন।
মানববন্ধন থেকে বক্তারা পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধের দাবি জানান। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিগত নিপীড়ন ও অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেশের সকল প্রগতিশীল ও মানবাধিকার সংগঠন, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ ও ব্যক্তিগণের প্রতি আহ্বান জানান। একই সাথে তারা পাহাড় ও সমতলের নিপীড়িত জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একযোগে আন্দোলন গড়ে তোলারও আহ্বান জানিয়েছেন।