আজ ১৭ নভেম্বর ২০২১ নান্যাচর গণহত্যার ২৮ বছর পূর্ণ হলো।। ১৯৯৩ সালের এই দিনে রাঙামাটির নান্যাচরে সেনাবাহিনী ও সেটলার বাঙালিরা নিরীহ জুম্ম জনসাধারণের উপর নির্বিচার হামলা চালিয়ে ৩০ জনের অধিক জুম্মকে নির্মমভাবে হত্যা ও বহু লোককে আহত করে এবং ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। দীর্ঘ ২৮ বছরেও রাষ্ট্র এই বর্বর গণহত্যার বিচারের কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
ঘটনার পটভূমি
২৭ অক্টোবর’৯৩ ছিল পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নান্যাচর থানা শাখার সম্মেলন। এই সম্মেলন সফল করতে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ নান্যাচরে যান। সম্মেলন শেষে পরদিন কেন্দ্রীয় ও বিভিন্ন শাখা থেকে আসা পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতৃবৃন্দ মহালছড়ি হয়ে খাগড়াছড়ি রওনা দেয়ার উদ্দেশ্যে নান্যাচর বাজার লঞ্চঘাটের যাত্রীছাউনির এক পাশে বসলে সেখানে চেকপোষ্ট বানিয়ে পাহারায় থাকা সেনা সদস্যরা বসতে নিষেধ করে। এতে সেখানে উপস্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতা-কর্মীরা সেনা সদস্যরা অনুরোধ করে বলেন, যাত্রী ছাউনি হচ্ছে জনসাধারণের বিশ্রামের জায়গা, সুতরাং এখানে বসতেতো কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু সেনা সদস্যরা এতে ক্ষিপ্ত হয়ে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতৃবৃন্দের সাথে খারাপ আচরণ ও অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। এর প্রতিবাদে সেখানে উপস্থিত ছাত্ররা তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিবাদ সমাবেশ করেন এবং যাত্রী ছাউনি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান।
এরপর ২ নভেম্বর পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ-এর নান্যাচর থানা শাখার পক্ষ থেকে তৎকালীন থানা নির্বাহী কর্মকর্তা (টিএনও) মোঃ হাবিবুর রহমানের মাধ্যমে জেলা প্রশাসকের বরাবরে একটি স্মারকলিপি প্রদান করা হয। এতে ১৬ নভেম্বরের মধ্যে যাত্রী ছাউনি থেকে সেনা চেকপোষ্ট সরিয়ে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার দাবি জানানো হয়। হাবিবুর রহমান জেলা প্রশাসকের সাথে যোগাযোগ করে উল্লেখিত তারিখের মধ্যে বিহিত ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন। কিন্তু এর মধ্যে কার্যকরী কোন পদক্ষেপ না নিয়ে ১১ নভেম্বর থানা নির্বাহী কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান ও তৎকালীন নান্যাচর জোন কমাণ্ডার লে. কর্নেল মোঃ আবু নাঈম বুড়িঘাট ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ আব্দুল লতিফসহ কয়েকজন সেটলার নেতৃবৃন্দের সাথে গোপন বৈঠক করে ১৭ নভেম্বর হত্যাকাণ্ডের নীলনক্সা প্রণয়ন করেন। এর অংশ হিসেবে ঘটনার দুদিন আগে থানা নির্বাহী কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান নান্যাচর ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যান।
১৭ নভেম্বর যা ঘটেছিল
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, সেদিন ছিল নান্যাচর বাজারের হাটের দিন। সাপ্তাহিক হাটবার হওয়ায় বিভিন্ন এলাকা থেকে জুম্ম নারী-পুরুষ বাজার করতে এসেছিলেন।
এদিকে স্মারকলিপির দাবি অনুযায়ী প্রশাসন বাজারের লঞ্চঘাটের যাত্রী ছাউনিকে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে না দেয়ায় সেদিন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ বাজার বয়কটের আহ্বান জানিয়ে একটি মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন করে।
বেলা প্রায় পৌনে ১টা। হঠাৎ পার্বত্য গণপরিষদ নামধারী একদল বহিরাগত বাঙালি লাঠি সোটা হাতে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক শ্লোগান সহকারে সমাবেশের দিকে এগিয়ে আসে। চারিদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। জুম্মরা সন্ত্রস্ত হয়ে এদিকে সেদিকে ছুটোছুটি আরম্ভ করে। এ সময় প্রশাসন রহস্যজনকভাবে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
উত্তেজনা কিছুটা কমে আসলে জুম্মরা আবারো যার যার মতো সওদা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
সেই মুহুর্তে বুড়িঘাট, বগাছড়ি ও ইসলামপুর থেকে ট্রলার ও নৌকাযোগে বেশ কয়েক শত বহিরাগত বাঙালি দা, বর্শা, বল্লম, ছোড়া, কুড়াল ইত্যাদি হাতে উত্তেজিত শ্লোগান সহকারে বিনা বাধায় লঞ্চঘাটে ভিড়ে এবং যাত্রী ছাউনীতে সেনা অবস্থানের পাশে জড়ো হয়। আক্রমণ ঠেকানোর জন্য জুম্মরাও লাঠি সোটা নিয়ে আত্মরক্ষার ভূমিকা নিতে বাধ্য হয়। বিষয়টি ওসি আমজাদ হোসেনকে জানানো হলে তিনি বলেন-“কিছু হবে না, আমরা রয়েছি।
ইতিমধ্যে বহিরাগত বাঙালিরা ইসলামপুর নামক স্থানে রাঙামাটিগামী পাহাড়িদের উপর হামলা চালায়। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে পাহাড়িরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু পাহাড়িদের পালানোর পথ বন্ধ করে দিয়ে সেটলাররা লঞ্চঘাটে ধারালো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অবস্থান নিয়ে পাহাড়িদের উদ্দেশ্য উস্কানিমূলক শ্লোগান দিতে থাকে। তাদের সাথে রয়েছে আর্মিরাও।
সেটলার বাঙালিদের এই উস্কামিূলক আচরণের বিষয়ে প্রশাসনকে বার বার জানানো সত্ত্বেও কোন কাজ হয়নি। তারা দেখেও না দেখার ভাণ করে উত্তেজনা প্রশমনের কৃত্রিম প্রচেষ্টা চালায়।
এর ফাঁকে প্রায় ৭/৮শত বাঙালিকে ধারালো অস্ত্রে সজ্জিত করে যাত্রী ছাউনী সংলগ্ন দক্ষিণে হসপিটাল রোডে জড়ো করে রাখা হয়।
বেলা ৩টা ৫৮ মিনিট। হঠাৎ স্বাভাবিকভাবে চলাফেরারত সমর কান্তি চাকমার উপর উস্কানীমূলকভাবে বহিরাগত বাঙালিরা আক্রমণ করে। ইট ছোঁড়া হয় তাকে লক্ষ্য করে। তাঁর মাথা ফেটে যায়।
এ সময় যাত্রী ছাউনীতে একটি হুইসেল উচ্চস্বরে বেজে উঠে। সঙ্গে সঙ্গে দা, কিরিচ, খন্তা, কুড়াল, মুগুর ইত্যাদি উচিয়ে বাঙালিরা ইট ছুঁড়তে ছুঁড়তে জুম্মদের দিকে ধেয়ে আসে।
জুম্মরাও আত্মরক্ষা করতে সচেষ্ট হয়। প্রায় ২০/২৫ জন পুলিশ যাত্রী ছাউনীর পাশের এক কোণা থেকে এ দৃশ্য প্রাণভয়ে চেয়ে থাকে। জুম্মরা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বাহিরাগত বাঙালিরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। কিন্তু বাঙালিদের এই পিছু হটাকে যাত্রী ছাউনীতে অবস্থানরত আর্মিরা সহ্য করতে পারলো না।
সেনারা তাদের সাহস ও বীরত্ব দেখাতে তাদের স্বয়ংক্রিয় রাইফেল থেকে তাজা গুলি ছুঁড়তে লাগলো নিরস্ত্র জুম্মদের তাক করে। তৎকালীন নান্যাচর জোনের উপ-অধিনায়ক(টুআইসি) মেজর মোস্তাফিজ এ হামলার নেতৃত্ব দেন।
সেনাদের ছোঁড়া গুলিতে মুহুর্তের মধ্যে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শোভাপূর্ণ চাকমা, কালাবিজা চাকমা, অর্জুন মণি চাকমা ও ধীরেন্দ্র চাকমাসহ অনেকে। ভূজন, কৌশল্যাসহ অনেকে আহত হলেন এ নির্বিচার গুলিতে । চারিদিকে রক্তে লাল হয়ে উঠলো নান্যাচরের মাটি। সাথে সাথে সেটলাররা ৩০টি জুম্ম বাড়ীতে তারা আগুন ধরিয়ে দেয়। বাড়ি ও দোকানে তল্লাসি চালিয়ে জুম্মদের হত্যা ও আহত করা হয়। তল্লাসির সময় সেনা সদস্যরা বন্দুকের বেয়নেট ও বাট দিয়ে আধমরা করে রাখে, অত:পর তাদের সহযোগী বহিরাগত বাঙালিরা ধারালো অস্ত্রে তাদের হত্যা করে।
নিজ বাড়িতেই অনেক জুম্মকে খুন ও আহত করা হয়। সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় বহিরাগত বাঙালিরা জুম্মদের সর্বস্ব লুট করে নিয়ে যায়।
বিকাল প্রায় ৫টার দিকে রাঙামাটি থেকে একটি যাত্রীবাহী লঞ্চ যখন নান্যাচর লঞ্চঘাটে পৌঁছে তখন সেনাবাহিনী ও পুলিশের সামনে বাঙালিররা জুম্ম যাত্রীদের উপর আক্রমণ করে।
এতে বেশ কয়েকজনকে কুপিয়ে আহত করা হয়।
এ হত্যাযজ্ঞে ৩০ জনের অধিক পাহাড়িকে হত্যা করা হয়। এছাড়া হামলায় কমপক্ষে ১৬০ জনের অধিক জুম্ম আহত হয়। অনেকে নিখোঁজ হয়ে যায়। ধর্মীয় গুরুরাও এই বর্বর হামলা থেকে রেহাই পায়নি।
নান্যাচর গণহত্যাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগণের উপর এ যাবতকালে ডজনের অধিক গণহত্যা ও কয়েক ডজন সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কোন ঘটনারই সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হয়নি।