আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস: আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষা এখনো সুদূর পরাহত

নিজস্ব প্রতিবেদক।। আজ ২১শে ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ১৯৯৯ সালে ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো কর্তৃক ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু দুই দশকের অধিক সময় কালেও বাংলাদেশসহ বিশ্বের দেশে দেশে অধিকাংশ আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর লোকজন নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত রয়েছে।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ১৯৯৯ সালে ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো কর্তৃক ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করায় একুশে’র তাৎপর্য একদিকে যেমন সারা বিশ্বের সকল মানব জাতির কাছে বৃদ্ধি পেয়েছে, অন্যদিকে ভাষা শহীদদের আত্মদানের মর্যাদা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।

তাই যে দিবস এক সময় শুধু বাঙালি জাতির শহীদ দিবস হিসেবে পালিত হতো তা আজ আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে, সেজন্য মহান একুশ এখন আর কেবল বাঙালির নয়, সমগ্র মানব জাতির। পাশাপাশি আাদিবাসী জাতিসমূহের কাছে এই দিবসটি আজ নিজ মাতৃভাষা রক্ষার প্রেরণা ও উৎসাহ যুগিয়ে আসছে।

বাংলা ভাষা একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হওয়ায় বাংলাদেশের আদিবাসীদের বাংলা ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ ও রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলা ভাষা ব্যবহার ও কথা বলতে হয়। নিজ পরিবারে মাতৃভাষায় কথা বললেও মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের কোন সুযোগ নেই। ফলে উচ্চ শিক্ষিত ও শহুরে আদিবাসী পরিবারের শিশুরা আজ নিজ মাতৃভাষা ভুলতে বসেছে।

ডানকান ওয়াকার-এর ভাষ্য মতে বর্তমানে বিশ্বে প্রতি মাসে ২টি ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। গার্ডিয়ান পত্রিকার মতে আগামী ১০০ বৎসরের মধ্যে প্রায় ৩০০০ ভাষা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের ১০টি ভাষাও এই অবলুপ্তির আশঙ্কা থেকে মুক্ত নয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা বিষয়ক গবেষণায় দেখা যায় যে, আদিবাসী শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা থেকে ঝড়ে পড়ার হার ৬০% থেকে ৭০%, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে এই হার ৩০% থেকে ৪০%। গবেষণায় প্রতীয়মান হয়েছে যে, এই ঝড়ে পড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে ভাষাগত সমস্যা।

যেহেতু একদিকে তার শিক্ষা জীবনের প্রথম দিনে যদি স্কুলে এসে শিক্ষকের কোন কথা বুঝতে না পারে, তাহলে সে কিভাবে শিক্ষা শুরু করবে? তার কাছে স্কুলটি যেমন অপরিচিত, ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষক অপরিচিত সেক্ষেত্রে দ্বিতীয় দিনে সে কিভাবে স্কুলে যেতে উৎসাহিত হবে? এমন পরিবিশে একটি শিশুকে ঠেলে দেওয়ার অর্থ হলো স্কুল আর শিক্ষাকে তার কাছে দুর্বোধ্য করে তোলা।

অপর দিকে স্কুলে এসে যদি সে নিজ মাতৃভাষা কথা বলতে ও শিক্ষা গ্রহণ শুরু করতে পারে, সে শিক্ষা তার কাছে সহজ ও বোধগম্য হবে, শিক্ষা গ্রহণে সে উৎসাহিত হবে নিসন্দেহে। স্বভাবতই একটি শিশু নিজ মাতৃভাষায় যত সহজে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে অন্য ভাষায় কখনও পারে না।

মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণের এ গুরুত্ব অনুধাবন করে বাংলাদেশে আদিবাসী শিশুদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষায় আদিবাসী ভাষা প্রচলনের অতীব প্রয়োজন। তাই আজ আদিবাসীদের শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষায় আদিবাসী ভাষা প্রয়োগ ও প্রচলনের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু এবিষয়ে সরকারিভাবে যথাযথ কার্যকর উদ্যোগ এযাবত গ্রহণ করা হয়নি।

বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ১৯৯৭ সনের ২রা ডিসেম্বরে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির (খ) অনুচ্ছেদের ৩৩নং ধারায় পার্বত্য চট্টগ্রামে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান বিষয়টি স্বীকার করে নেয়া হয়েছে এবং চুক্তি মোতাবেক সংশোধিত পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

তদুপরি আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থা (আইএলও) এর ৪০তম অধিবেশনে কনভেনশন-১০৭-এর ২৩(১) ধারায় আদিবাসী ও উপজাতীয় শিশুদের তাদের নিজস্ব মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রদানের অধিকার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।

জাতিসংঘের কর্মপরিকল্পনায় শিক্ষা বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে যে সুপারিশ করা হয়েছে তা হলো, মাতৃভাষায়, দ্বৈত ভাষায় শিক্ষা এবং আন্ত:সাংস্কৃতিক শিক্ষা উপর গুরুত্বারোপ করা; সমন্বিত শিক্ষা কার্যক্রমে ও পাঠ্যক্রমে আদিবাসীদের শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণ পদ্ধতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, অধিকার, আধ্যাত্মিকতা এবং বিশ্ব সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও তাদের জীবনধারণের পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত করা; শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আদিবাসী শিক্ষকদের প্রবেশাধিকার বা অধ্যয়নের জন্য বৃত্তি প্রদানসহ রাষ্ট্রসমূহের বর্ধিত বাজেট বরাদ্দ করা ইত্যাদি।

আদিবাসীদের শিক্ষা ক্ষেত্রে নীতিগত বিষয়ে সরকারী কার্যক্রমের অন্যতম উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো- ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষা নীতিতে আদিবাসী বিষয়ে বিশেষ বিধান অন্তর্ভুক্ত করা। শিক্ষানীতিতে উল্লেখ রয়েছে যে-

“১৮. আদিবাসী শিশুরা যাতে নিজেদের ভাষা শিখতে পারে সেই লক্ষ্যে তাদের জন্য আদিবাসী শিক্ষক ওপাঠ্যপুস্তকের ব্যবস্থা করা হবে। এই কাজে, বিশেষ করে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে, আদিবাসী সমাজকেস¤পৃক্ত করা হবে।”

“১৯. আদিবাসী প্রান্তিক শিশুদের জন্য বিশেষ সহায়তার ব্যবস্থা করা হবে।”

“২০. আদিবাসী অধ্যুষিত (পাহাড় কিংবা সমতল) যেসকল এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই সেসকলএলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হবে। যেহেতু কোনো কোনো এলাকায় আদিবাসীদের বসতিহালকা তাই একটি বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে শিক্ষার্থী ওশিক্ষকদের আবাসিক ব্যবস্থার প্রয়োজন হলে সেদিকেও নজর দেওয়া হবে।”

জাতীয় শিক্ষা নীতিতে আদিবাসী শিশুদের শিক্ষা বিষয়ে উল্লেখিত বিধানাবলী নি:সন্দেহে যথেষ্ট ইতিবাচক বলা যায়। তবে শিক্ষা নীতিতে উল্লেখিত ‘আদিবাসী শিশুরা যাতে নিজেদের ভাষা শিখতে পারে সেই লক্ষ্যে তাদের জন্য আদিবাসী শিক্ষক ও পাঠ্যপুস্তকের ব্যবস্থা করা হবে’ এই বক্তব্য বেশ বিভ্রান্তিমূলক। কারণ আদিবাসীরা পরিবারের মধ্যে নিজেদের ভাষা শিখে থাকে। তাদের প্রয়োজন হচ্ছে ‘নিজেদের ভাষায় শিক্ষা’ গ্রহণের সুযোগ প্রদান করা।

কিন্তু জাতীয় শিক্ষা নীতিতে মাতৃভাষায় শিক্ষার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে আসেনি। অধিকন্তু শিক্ষানীতির এই পরিকল্পনাগুলো এখনো নীতিমালাতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। এখনো তা যথাযথ বাস্তবায়নের মুখে দেখেনি। কিন্তু আদিবাসী ছেলেমেয়েদের নিজস্ব মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার সুযোগ থেকে এখনো বঞ্চিত।

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষা রক্ষায় দীর্ঘদিনের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সরকার চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো ও সাদরি-এই পাঁচ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রাক-প্রাথমিকের শিশুদের মাতৃভাষায় পাঠদানের কার্যক্রম শুরু করে ২০১৭ সালে। প্রাক-প্রাথমিকের বইয়ের আদলে রচনা হয়েছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় শিক্ষার বই।

২৫ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে বাংলা ত্রিবিউনের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, “নানা সংকটে আছে এই মাতৃভাষা শিক্ষা। খাগড়াছড়ির কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরে জানা যায়, শিক্ষকদের কাছে মোটামুটি এক ধরনের চ্যালেঞ্জ শিক্ষার্থীদের পড়ানো। কারণ অনেক শিক্ষকই নিজ নিজ ভাষায় লিখতে ও পড়তে জানেন না। তাদের লেখাপড়া পার হয়েছে বাংলা ভাষা শিখে। সে জন্য তাদের নিজেদেরও নিজ নিজ ভাষায় পড়া ও লেখার জন্য প্রশিক্ষণ নিতে হয়। অনেক স্কুলে আবার রয়েছে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একই মাতৃভাষা ব্যবহারকারী শিক্ষকের সংখ্যার স্বল্পতা। সবার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নানা সংকটে অনেকটা ধুঁকে ধুঁকে চলছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম।”

একথা ঠিক যে, প্রাথমিক শিক্ষায় আদিবাসী ভাষা প্রয়োগ ও প্রচলনের ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা রয়েছে। যেমন লিপি সমস্যা, শিক্ষকের সমস্যা, পাঠ্য বইয়ের সমস্যা ইত্যাদি। মূলত এগুলো কিন্তু কোন মৌলিক সমস্যা নয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা হল সদিচ্ছা ও উদ্যোগহীনতা।

সেক্ষেত্রে মূল উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের কার্যকর করতে হবে। এরপর স্থানীয় সরকারী প্রতিষ্ঠানসমুহ যেমন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদসমুহ আদিবাসী ভাষাসমুহের লিপি সমস্যা সমাধান, পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়নের উদ্যোগ নিতে পারে।

এক্ষেত্রে আদিবাসীদের ভাষা ভিত্তিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানসমুহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এই বাস্তবতার আলোকে বলতে হয় প্রকৃতপক্ষে আদিবাসী সংগঠনসমূহকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।

উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে আদিবাসীদের শিক্ষার পশ্চাদপদতার কথা বিবেচনা করে সরকার আদিবাসী ছাত্র-ছাত্রীদের কোটা ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এই কোটা ব্যবস্থা চালু আছে এডহক ভিত্তিতে; লিখিত বা আইনানুগ কোন নীতিমালা নেই। ফলতঃ যদি কোন আদিবাসী ছাত্র-ছাত্রী জেনারেল প্রতিযোগিতায় যোগ্যতা লাভ করে তাকেও কোটায় ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। এটা কোটার মূল উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে।

আদিবাসী কোটা বিষয়ে সুনিদিষ্ট নীতিমালা না থাকায় কোন কোন বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্র্তৃপক্ষের সহানুভুতির উপর কোটা দেয়া না দেয়া নির্ভর করে। বিদেশে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ ও গবেষণার জন্যও সুনির্দিষ্ট কোন কোটা নেই। অপরদিকে আদিবাসী ছাত্র-ছাত্রীদের উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রধান বাধা আর্থিক অস্বচ্ছলতা। এসব গরীব ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের পর্যাপ্ত পরিমাণে আর্থিক সাহাষ্য দেয়ার সরকারিভাবে কোন ব্যবস্থা নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *