সনদ বাস্তবায়নে সংসদকে বাধ্য করার উপায় পায়নি কমিশন

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে যে ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ গঠিত হবে, তার হাতে যেতে পারে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের দায়িত্ব। ৯ মাসের মধ্যে সনদ বাস্তবায়নের শর্ত দেওয়া হবে তাদের। কিন্তু পরিষদ শর্ত না মানলে কী হবে, তা ঠিক করতে পারেনি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। ফলে গণভোটে সাংবিধানিক আদেশ অনুমোদিত হলেও জুলাই সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটেনি। বিশেষজ্ঞরা সনদ বাস্তবায়নে নির্দেশনামূলক পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু কমিশন বাধ্যতামূলক করতে চায়, তবে তার উপায় বের করতে পারেনি।

গতকাল শনিবারও বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সঙ্গে বৈঠক করেছে কমিশন। বৈঠক সূত্র সমকালকে জানায়, আগামী সংসদের কাঠামো এবং জুলাই সনদ বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক, নাকি নির্দেশনামূলক হবে– এ বিতর্কে আলোচনা ঘুরপাক খাচ্ছে। ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন (সংবিধান সংস্কার) আদেশে’ ৯ মাসের মধ্যে সনদ বাস্তবায়ন নির্দেশনামূলক রাখার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

তবে গতকাল রাতে কমিশন সূত্র সমকালকে জানায়, বাধ্যতামূলক করার কোনো না কোনো পথ রাখা হবে, যা ঠিক হতে পারে আজ রোববারের বৈঠকে।

বৈঠক সূত্র জানায়, সাংবিধানিক আদেশের কাঠামো তৈরি হয়েছে। আজ কমিশনের বৈঠকে প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ প্যানেলের মতামত নেওয়া হবে। এর মাধ্যমে চূড়ান্ত করা হবে সাংবিধানিক আদেশের খসড়া। এরপর জুলাই সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি সরকারকে সুপারিশ করবে কমিশন। সরকার সাংবিধানিক আদেশ জারি করবে। তাতে বলা থাকবে, গণভোট কবে হবে।

জানতে চাইলে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ গতকাল সমকালকে বলেন, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠকে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। আদেশের কাঠামো অনেকটাই প্রস্তুত। শিগগির খসড়া চূড়ান্ত করা হবে।

আদেশের কাঠামো তৈরি
বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, সাংবিধানিক আদেশের নাম হবে ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন (সংবিধান সংস্কার) আদেশ-২০২৫’।  গত কয়েক দিনের বৈঠকে এর যে কাঠামো তৈরি হয়েছে তা হলো– জুলাই সনদ নয়, গণভোট হবে এ আদেশের ওপর। জনগণ অনুমোদন দিলে আগামী সংসদ দ্বৈত ভূমিকায় থাকবে। একই সঙ্গে সংসদ ও সংবিধান সংস্কার পরিষদের দায়িত্ব পালন করবে। সরকার গঠন ও আইন প্রণয়ন করবে সংসদ। আর পরিষদ ৯ মাসের মধ্যে সংবিধান সংশোধন, পরিমার্জন, পরিবর্তন করে জুলাই সনদে উল্লিখিত সংস্কারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে। গণভোটে প্রাপ্ত কন্সটিটুয়েন্ট পাওয়ারে (গাঠনিক ক্ষমতা) সংবিধানের মৌলিক কাঠামো বদল করতে পারবে।

গতকাল সকালে সংসদে এনসিপির সঙ্গে বৈঠক করে ঐকমত্য কমিশন। এর পর দুপুর থেকে চার ঘণ্টা বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সঙ্গে বৈঠক করে। 
জুলাই সনদে সই না করা এনসিপির দাবি, সাংবিধানিক আদেশ ও গণভোটের মাধ্যমে আগামী সংসদের জন্য জুলাই সনদ বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক করতে হবে। তবেই তারা সনদে সই করবে।

কমিশনের এক সদস্য সমকালকে বলেন, বৈঠকে এনসিপির প্রতিনিধিরা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, তারা সনদে সই করতে চান। তবে কিছু প্রস্তাবের বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছেন। সেগুলো বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠানো হয়েছে ব্যাখ্যার জন্য। এনসিপির প্রস্তাবে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটি দিকই আছে। সেগুলো বিবেচনা করে এগোচ্ছি। মূল লক্ষ্য, সব দল যেন সনদে সই করে।

সংসদকে বাধ্য করতে তিন বাধা
কমিশন ও বিশেষজ্ঞ প্যানেলের দুই সদস্য সমকালকে বলেন, নির্ধারিত ৯ মাসের মধ্যে সনদ অনুযায়ী সংবিধান সংস্কার না করলে কী হবে– এ-সংক্রান্ত তিনটি বিকল্প নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। প্রথম বিকল্প– ৯ মাসের মধ্যে ব্যর্থ হলে সাংবিধানিক সংস্কার পরিষদ ও সংসদ বিলুপ্ত হবে। নতুন নির্বাচনে নতুন করে পরিষদ গঠিত হবে। কিন্তু এতে সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংকটের আশঙ্কা রয়েছে। আইনিভাবে এ প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য হলেও রাজনৈতিকভাবে নয়। কারণ, সংস্কার না করার কারণে ৯ মাস পর সংসদ বিলুপ্ত হলে পরের নির্বাচন কার অধীনে হবে, এর জবাব মিলছে না।

দ্বিতীয় বিকল্প– ৯ মাসের মধ্যে সংস্কার না করলে জুলাই সনদ অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধান সংশোধন হয়ে যাবে। এ প্রস্তাবও বাতিল হয়েছে আলোচনায়। কমিশনের এক সদস্য সমকালকে বলেন, সনদে সংস্কারের প্রথম সিদ্ধান্ত ভাষা-সংক্রান্ত। এতে বলা হয়েছে, বাংলা হবে রাষ্ট্রভাষা। নাগরিকদের অন্যান্য মাতৃভাষাও স্বীকৃতি পাবে। সনদে বলা হয়নি, কোন কোন ভাষা স্বীকৃতি পাবে। বিষয়টি নির্ধারণ করবে সংবিধান সংস্কার পরিষদ। জুলাই সনদ সংবিধান সংশোধনের বিল নয়, ফলে ৯ মাস পার হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধান সংস্কার সম্ভব নয়। এখনও কোনো সংস্কার বিল খসড়া করা হয়নি। কাজটি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের, যারা পরিষদ বা সংসদে বসে বিতর্কের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেবেন।

তৃতীয় বিকল্প– নির্বাচনের পর প্রথমে সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন হবে। দ্রুত সনদ অনুযায়ী সংস্কার করার পর পরিষদ সদস্যরা সংসদ গঠন করবেন। তারপর সরকার গঠিত হবে। বৈঠক সূত্র জানায়, এ পদ্ধতি আইনিভাবে সঠিক হলেও রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, নির্বাচনের পরও কয়েক মাস সংসদ গঠন না হলে সরকারে কে থাকবে? অন্তর্বর্তী সরকারকে ততদিন মানবে না রাজনৈতিক দলগুলো। বর্তমান সরকারও নির্বাচনের পর থাকতে রাজি নয়। কমিশন ২৭০ দিনের সময়সীমা রাখবে। কিন্তু সময় শেষে কী পরিণতি হবে, তা উল্লেখ থাকবে না সুপারিশে।

বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, এসব কারণে সনদ বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক না করে নির্দেশনামূলক করা হতে পারে আগামী সংসদের জন্য। সইকারী রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় গিয়ে সনদ মানবে– এই আশাবাদ ছাড়া কিছু করার নেই।

শেষ সময়েও সুরাহা হয়নি অনেক কিছু
গতকালের বৈঠকে আরেকটি আলোচ্য ছিল, জুলাই সনদ পরিষদে অনুমোদনের পদ্ধতি কী হবে? তা সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা, নাকি দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় অনুমোদন করবে?– এসব নিয়েও মতভেদ রয়ে গেছে।

সূত্র জানায়, বাহাত্তরের গণপরিষদ সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সংবিধান অনুমোদন করেছিল। পৃথিবীর সব দেশেই এই নীতি অনুসরণ করা হয়। কিন্তু সংবিধান সংশোধনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা বাধ্যতামূলক। বৈঠকে অংশ নেওয়া এক সদস্য বলেছেন, জুলাই সনদে যেসব সংস্কারের সিদ্ধান্ত রয়েছে, সেগুলো সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায়, অর্থাৎ ১৫১ আসন পেলে অনুমোদন করতে পারবে পরিষদ। জুলাই সনদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে দুই-তৃতীয়াংশ তথা ২০০ এমপির সমর্থন লাগবে– এমন বিধান রাখার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

বৈঠকে পরিষদ ও সংসদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, সংসদের স্পিকার ও পরিষদের চেয়ারম্যান একই ব্যক্তি হবেন। আর বিষয়টি উল্লেখ থাকবে সাংবিধানিক আদেশে। 

জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির দাবি, আওয়ামী লীগ মনোনীত রাষ্ট্রপতি নয়, সাংবিধানিক আদেশ জারি করবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গঠিত সরকারপ্রধান। কমিশন সূত্র জানিয়েছে, এ বিষয়ে তারা সুপারিশ করবে না। এ সিদ্ধান্ত নেবে সরকার।

বিশেষজ্ঞ প্যানেলের এক সদস্য বলেছেন, এমন পথ খোঁজা হচ্ছে, যা রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ও আইনিভাবে টেকসই। গণভোট নির্বাচনের দিনেও হতে পারে; আবার আগে করাও সম্ভব। এটা সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে।

নোট অব ডিসেন্ট নিয়ে জটিলতা
জুলাই সনদের ৮৪টি সংস্কারের মধ্যে পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠনসহ ৯টি মৌলিক সংস্কারের সিদ্ধান্তে বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) রয়েছে। দলটি বলছে, ক্ষমতায় গেলে এগুলো বাস্তবায়ন করবে না। জামায়াত, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলনের দাবি, পুরো সনদ নিয়ে গণভোট হতে হবে। গণভোট অনুমোদন করলে পুরো সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে।

আগের দুদিনের মতো গতকালের বৈঠকেও নোট অব ডিসেন্টের সুরাহা হয়নি। বিশেষজ্ঞ প্যানেল পরামর্শ দিয়েছে, গণভোটে নোট অব ডিসেন্ট থাকবে না। নোট অব ডিসেন্ট থাকলে কার্যত সংস্কার হবে না। গণভোট হবে একটি প্রশ্নে।

বিএনপি এবং সমমনা দলগুলোর আপত্তির কারণে কমিশন এ বিষয়ে গতকালও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। তবে এক সদস্য জানিয়েছেন, কমিশন নোট অব ডিসেন্ট রাখতে চায় না। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। সরকারপ্রধান সব দলের ঐকমত্যে জোর দিচ্ছেন। ফলে কমিশন ভিন্নমত না রাখার সুপারিশ করলেও, সরকার তা কার্যকর করে আদেশ জারি করবে কিনা সন্দেহ রয়েছে।

বৈঠকে অংশ নেন বিচারপতি এম এ মতিন, বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন মোহাম্মদ ইকরামুল হক, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শরিফ ভূঁইয়া, ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক এবং ব্যারিস্টার তানিম হোসাইন শাওন।

কমিশনের পক্ষে ছিলেন সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, বিচারপতি এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, সফর রাজ হোসেন, মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *