ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে দেশি ৬৬টি সংস্থা চূড়ান্ত নিবন্ধন পেয়েছে। বাদ পড়েছে সাত প্রতিষ্ঠান। তবে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) চূড়ান্ত তালিকাতেও কয়েকটি সংস্থার হদিস পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া নিবন্ধন পাওয়ার জন্য কিছু প্রতিষ্ঠানে সাইনবোর্ড, চেয়ার-টেবিল বসিয়ে সাজসজ্জা বাড়ানো হয়েছে। আবার ক্ষুদ্রঋণসহ ভিন্নধারার কার্যক্রমে যুক্ত প্রতিষ্ঠানও পেয়েছে নিবন্ধন।
নির্বাচনে পর্যবেক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য গত ২৮ সেপ্টেম্বর ৭৩টি স্থানীয় সংস্থার প্রাথমিক তালিকা দিয়ে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ইসি। নিষ্পত্তি শেষে গত ৬ নভেম্বর ৬৬ সংস্থাকে চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।
আবেদনের ঠিকানায় নেই কয়েকটি সংস্থা
ভলান্টারি রুরাল ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি (ভিআরডিএস) চূড়ান্ত নিবন্ধন পেয়েছে, নম্বর ৪০। আবেদনে দেওয়া ঠিকানায় তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। ভিআরডিএসের ঠিকানা হিসেবে উল্লেখ করা হয় রাজধানীর রামপুরা বনশ্রীর ‘ফ’ ব্লকের ৭ নম্বর সড়কের ৫৯ নম্বর বাড়ি। গত রোববার বনশ্রী এলাকা ঘুরে এমন অফিসের সন্ধান পায়নি সমকাল। এলাকাবাসী জানান, বনশ্রীর ব্লকগুলো ইংরেজিতে। তাই ‘ফ’ ব্লকের ইংরেজি বর্ণ ‘এফ’ ধরে ৭ নম্বর সড়কে গিয়ে জানা যায়, সেখানে মাত্র ৩৭ নম্বর পর্যন্ত হোল্ডিং রয়েছে।
ঢাকার ৪০/১, জাফরাবাদ, রায়েরবাজার ঠিকানায় কমিউনিটি অ্যাসিস্ট্যান্ট ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট (কার্ড) কার্যালয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয় পাওয়া যায়নি। সেখানে দেখা যায়, একতলা ভবনে একটি পরিবার বসবাস করছে। বাসার মধ্যবয়সী পুরুষ সদস্য নাম প্রকাশ না করে জানান, এখানে তারা বসবাস করেন; কোনো অফিস নেই।
৪০/এ, জাফরাবাদ, রায়েরবাজার– ঠিকানায় পাশের ভবনের মালিক আমানুল্লাহ ফারুকী। জাফরাবাদ জামে মসজিদের এই ইমাম জানান, এলাকায় কার্ড নামে কোনো সংস্থার কার্যক্রম সম্পর্কে তাঁর জানা নেই।
ইসির তালিকায় ৩৯ নম্বরে প্রত্যয় সোশ্যাল ফাউন্ডেশন। চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশের গাউসুল আজম জামে মসজিদের সম্মুখে দ্বিতীয় তলা, মোমেনবাগ আবাসিক, আমিন জুট মিলস, চট্টগ্রাম-৪২২১ ঠিকানায় সংস্থার কার্যালয় নেই। এই নামে আশপাশেও কোনো সংস্থার কার্যক্রম সম্পর্কে জানেন না এলাকাবাসী। সংস্থার নির্বাহী প্রধান নেছারুল ইসলাম নাজমুল নামের সঙ্গেও তারা পরিচিত নন বলে জানিয়েছেন।
গত রোববার সংশ্লিষ্ট ভবনের দ্বিতীয় তলায় কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ‘ফাস্ট সেবা’, ‘হামজারবাগ কলোনি ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি’ ও ‘ভিস্তা কম্পিউটার একাডেমি’ নামে তিনটি প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড পাওয়া যায়। তবে সেগুলো তালা দেওয়া। নিচতলায় মুদি দোকান মেসার্স মাহি এন্টারপ্রাইজের কর্ণধার মো. এনাম সমকালকে বলেন, ‘প্রত্যয় নামে কোনো সংস্থার অফিস এই ভবনে আমি কখনও দেখিনি।’
নরসিংদী শহরের বিলাসদী ৫৬, কোর্ট রোডে জামান মঞ্জিলে অর্গানাইজেশন ফর সোশ্যাল অ্যাডভান্সমেন্টের (উষা) অফিস পাওয়া যায়নি। তবে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান জাকির হোসেন জাহাঙ্গীর জানান, কয়েক মাস আগে তারা কার্যালয় স্থানান্তর করেছেন।
বিলাসদীর ১৫৩/১ কোর্ট রোডের ঠিকানায় সাইনবোর্ডবিহীন অন্তরঙ্গ সমাজকল্যাণ সংস্থার (এএসকেএস) কার্যালয় পাওয়া যায়। কার্যক্রম সম্পর্কে উপস্থিত কেউই কিছু বলতে পারেননি। পরে ফোনে সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মতিউর রহমান ভূঁইয়া জানান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বয়স্কদের নিয়ে কাজ করেন। এবার তারা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে চান।
এসিয়ার কার্যালয়ে বিউটি পার্লার
ঝিনাইদহ শহরের চাকলাপাড়ায় অ্যাসোসিয়েশন ফর সোসিও ইকোনমিক অ্যাডভান্সমেন্টে (এসিয়া) গিয়ে তালা দেওয়া পাওয়া যায়। কার্যালয়ের একটি কক্ষে বিউটি পার্লারের কার্যক্রম চলছে। পার্লারের সাইনবোর্ডে থাকা মোবাইল নম্বরে কল দিলে এসিয়ার সাধারণ সম্পাদক পরিচয় দেওয়া মাহমুদা পারভীন বলেন, ‘সভাপতি আনোয়ার হোসেন অসুস্থ। আমাদের যথেষ্ট লোকবল রয়েছে। সবাই মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন।’
ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে জড়িত এমএসকে
জয়পুরহাট শহরের নওপাড়ায় টিনশেড একটি ঘরে মানব সহায়ক কেন্দ্রের (এমএসকে) প্রধান কার্যালয় পাওয়া যায়। এটিই সংস্থার প্রধান নির্বাহী এনামুল হকের বাসভবন। স্থানীয়রা জানান, ২০০২ সালে এনামুল হক এমএসকে প্রতিষ্ঠা করে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম শুরু করেন। মাঝে কয়েক বছর বন্ধ থাকলেও এখন সচল। এনামুল হক বলেন, ‘আমাদের লোকজন কম। জেলার অন্যান্য এনজিওর লোক সংযুক্ত করে দুটি আসন পর্যবেক্ষণের পরিকল্পনা করেছি।’
র্যাক মালিকের দুই ভাই বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষ নেতা
কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট কমিটি ফর বাংলাদেশ (র্যাক-বাংলাদেশ)-এর নির্বাহী পরিচালক ইবাদুর রহমান বাদলের বড় ভাই আজিজুর রহমান বাচ্চু গাজীরচর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি। ছোট ভাই আবদুল কাইয়ুম একই ইউনিয়ন জামায়াতে ইসলামীর আমিরের দায়িত্বে আছেন।
তবে কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন দাবি করে ইবাদুর রহমান বাদল বলেন, আমার প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্রঋণসহ বিভিন্ন সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোর্শেদ আলম জানান, র্যাক-বাংলাদেশ বিষয়ে তাঁর কাছে নির্বাচন কমিশন থেকে কোনো তথ্য চায়নি।
সচেতন নাগরিক সোসাইটি বিএনপি নেতার ভাইয়ের
দিনাজপুর শহরের উপশহর (পুরাতন) ব্লকের এ/১১ নম্বর বাড়ির নিচতলায় সচেতন নাগরিক সোসাইটির সাইনবোর্ড। ভেতরে চেয়ার-টেবিল, আসবাব কিছুই পাওয়া যায়নি। সংস্থার প্রতিষ্ঠাকালীন পরিচালক এমএসএইচ বাঁধন চৌধুরী জানান, সচেতন নাগরিক সোসাইটির বর্তমান চেয়ারম্যান সাবেক অতিরিক্ত সচিব সদর উদ্দিন আহমেদ। তাঁর ভাই সালেহ উদ্দিন আহমেদ হেলাল লালমনিরহাট-২ আসনে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য।
সদর উদ্দিন আহমেদ বলেন, এক সময় আমরা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সাঁতার প্রশিক্ষণ, পথশিশুদের পাঠশালা, নারীদের সেলাই, ব্লক-বুটিক প্রশিক্ষণ ও দুস্থদের জন্য কাজ করতাম। তহবিল সংকটে এখন সব কার্যক্রম বন্ধ। সুষ্ঠু নির্বাচন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য পর্যবেক্ষক সংস্থা হিসেবে আবেদন করেছিলাম। নিবন্ধন পেয়েছি।
দিনাজপুরের জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কর্মকর্তা জিলহাজ উদ্দিন জানান, নিবন্ধন বিষয়ে তাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। সব দেখভাল হয়েছে ঢাকা থেকে।
দিশা সমাজকল্যাণ সংস্থা
যশোর উপশহরের দিশা সমাজকল্যাণ সংস্থার বিরুদ্ধে উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর আওতায় পরিচালিত ‘সেকেন্ড চান্স এডুকেশন প্রকল্প’তে অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। বিভাগীয় তদন্তেও অভিযোগের প্রমাণ মেলে। বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্ত করছে।
ইসির নিবন্ধনে দিশার নির্বাহী পরিচালক হিসেবে সালমা পারভীনের নাম উল্লেখ থাকলেও প্রকৃতপক্ষে এ দায়িত্বে আছেন রাহিমা সুলতানা। তিনি বলেন, দুদক এখন পর্যন্ত আমাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা করেনি। অভিযোগের তদন্ত প্রাথমিক পর্যায়ে। ফলে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে বিশ্বাসযোগ্যতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই।
তিন মাসে একবার খোলে সেবার কার্যালয়
ময়মনসিংহের নান্দাইলের চণ্ডীপাশা মহল্লায় টিনশেড ঘরে ‘সেবা ফাউন্ডেশন’-এর সাইনবোর্ড পাওয়া যায়। একই সঙ্গে সেখানে রয়েছে ‘সেবা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়’। দুটি প্রতিষ্ঠানের দরজাই তালা দেওয়া।
স্থানীয় বাসিন্দা সোহরাব উদ্দিন বলেন, বিদ্যালয় ও ফাউন্ডেশনের কার্যালয় দুই-তিন মাসে একবার খুলতে দেখি। কখনও শিক্ষক-শিক্ষার্থী দেখিনি।
উপজেলা নির্বাচন অফিসার জন কেনেথ রিছিল জানান, চূড়ান্ত নিবন্ধনের আগে জেলা অতিরিক্ত নির্বাচন অফিসার সরেজমিন তদন্ত করেছেন। তিনিই এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন।
জেলা অতিরিক্ত নির্বাচন অফিসার মাহমুদুল আলম সমকালকে বলেন, সেবা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের এক পাশে সেবা ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ে আসবাবসহ দু-একজনকে কাজ করতে দেখেছি। এ বিষয়ে আমার কাছে প্রমাণও রয়েছে।