আ.লীগ প্রসঙ্গে তারেক রহমানের বক্তব্যে প্রতিশোধ মূলক কোন ভাষা নেই: মাসুদ কামাল

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামাল সম্প্রতি এক বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের টকশোতে অংশ নিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকার নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেন। অনুষ্ঠানে উপস্থাপিকা তার মতামত জানতে চাইলে মাসুদ কামাল বলেন, দীর্ঘ ১৭ বছর বিদেশে থাকার পর তারেক রহমানের মধ্যে তিনি বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন।

তিনি বলেন, “তারেক রহমান প্রায় ১৭ বছর ধরে বিদেশে আছেন—একটা গণতান্ত্রিক দেশে। সেখানে বসবাসের অভিজ্ঞতা, নিজস্ব প্রচেষ্টা কিংবা সময়ের প্রভাবে তিনি অনেক পরিণত হয়েছেন। তাঁর কথাবার্তায় এখন পরিমিতিবোধ, ধৈর্য এবং দায়িত্বশীলতা স্পষ্ট।”

মাসুদ কামাল স্মরণ করিয়ে দেন, অতীতে তারেক রহমানের একটি ফাঁস হওয়া ফোনালাপ তিনি গভীরভাবে শুনেছিলেন। “ওই কনভারসেশনে আমি একটা কথাও পাইনি, যার ওপর ভিত্তি করে তাকে নেতিবাচকভাবে ধরা যায়,” বলেন তিনি। “তার কথাবার্তায় পরিমিতি ও সংযম ছিল—যা আমাকে মুগ্ধ করেছিল।”

তিনি আরও বলেন, “যে মানুষ নানা অভিযোগ নিয়ে দেশ ছেড়েছিলেন, তিনি এখন সম্পূর্ণ বদলে গেছেন। তার মধ্যে একটা রাজনৈতিক পরিপক্বতা এসেছে, যা আমি তার বিবিসি সাক্ষাৎকারেও দেখেছি।”

মাসুদ কামাল বলেন, “সাক্ষাৎকারে তিনি (তারেক রহমান) আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করেছেন, কিন্তু কোথাও প্রতিশোধের ভাষা ব্যবহার করেননি। তিনি বলেছেন, আইন তার পথেই চলবে—‘দেশের প্রচলিত আইন বিচার করবে’। তিনি বলেননি যে ‘আমরা নতুন আইন বানাবো’। এই মনোভাবটা গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের ইঙ্গিত দেয়।”

তার মতে, “তারেক রহমান যে ন্যারেটিভ দাঁড় করাচ্ছেন, তা প্রতিহিংসার নয়—বরং ন্যায়বিচার ও পুনর্মিলনের পথে।”

মাসুদ কামাল সমালোচনা করেন দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে। তাঁর মতে, “গত ১৫ বছরে দেশের রাজনীতি এমনভাবে বিভক্ত করা হয়েছে যে, মানুষ এখন দল অনুযায়ী সম্পর্ক নির্ধারণ করে। আগে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক কর্মীরাও পারিবারিক অনুষ্ঠানে একসঙ্গে থাকত। এখন মনটাকেই ভাগ করে দেওয়া হয়েছে—একদল মনে করে দেশটা শুধু তাদের, অন্যদল ভাবে বিপরীত পক্ষের কেউ দেশের থাকতে পারবে না।”

তিনি বলেন, “এই বিভক্ত রাজনীতির মাঝে তারেক রহমানের বক্তব্য একটা মধ্যপন্থার বার্তা দিয়েছে—যেখানে প্রতিহিংসা নয়, যুক্তি ও ন্যায়বিচার প্রাধান্য পাচ্ছে।”

মাসুদ কামাল যদিও তারেক রহমানের সাক্ষাৎকারের প্রশংসা করেছেন, তবু বিবিসি বাংলার সাক্ষাৎকার গ্রহণ প্রক্রিয়া নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট নন। তাঁর মতে, “সাক্ষাৎকারে ২১ আগস্ট হামলার প্রসঙ্গসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করা হয়নি। ইন্টারভিউটি আরও গভীর ও কাঠামোবদ্ধ হতে পারত।”

তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, “ড. ইউনুসের সঙ্গে মেহেদী হাসানের করা সাক্ষাৎকারে যেমন সরাসরি ও তীক্ষ্ণ প্রশ্ন ছিল, তেমনটা এখানে দেখা যায়নি। যদি মেহেদী হাসান এই সাক্ষাৎকার নিতেন, তবে প্রশ্নের গভীরতা ভিন্ন হতো।”

উপস্থাপিকা জানতে চান—যদি তারেক রহমানের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ পেতেন, তাহলে কী প্রশ্ন করতেন?
জবাবে মাসুদ কামাল বলেন, “আমি অবশ্যই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, ২০০১-০৬ সালের শাসনকাল ও অতীতের বিতর্কিত ঘটনাগুলো নিয়ে প্রশ্ন করতাম। তবে প্রশ্ন করতাম বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিকভাবে, ব্যক্তিগত প্রতিশোধ নয়।”

মাসুদ কামাল স্মরণ করেন, ১৯৯৮ সালে তিনি খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন, যখন তিনি জনকণ্ঠে কাজ করতেন—যা ছিল আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ একটি পত্রিকা। “লিখিত প্রশ্ন পাঠানোর নিয়ম থাকা সত্ত্বেও আমি তা মানিনি। সরাসরি প্রশ্ন করেছিলাম। দেড় ঘণ্টার সাক্ষাৎকার শেষে খালেদা জিয়াকে বলেছিলাম, আপনি তো ভালো বলেন, তাহলে লিখিত প্রশ্ন কেন লাগল? তিনি বলেছিলেন—‘আমি তো লিখিত প্রশ্ন চাইনি।’”

এই অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, “একজন পরিণত রাজনৈতিক নেতা মিডিয়াকে কীভাবে মোকাবিলা করতে হয় তা জানেন। তারেক রহমানও এখন সেই জায়গায় পৌঁছেছেন বলে মনে করি।”

আলোচনার শেষে মাসুদ কামাল বলেন,
“তারেক রহমানের বক্তব্যে আমি একজন পরিণত রাজনীতিকের সুর শুনেছি। প্রতিহিংসার ভাষা নয়, বরং সংলাপ ও আইনের শাসনের প্রতি বিশ্বাস দেখেছি। এই মানসিকতার মানুষই রাষ্ট্র পরিচালনায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে।”

তিনি আরও যোগ করেন, “আমি কারও দালালি করি না। আমি শুধু চাই, যে-ই ক্ষমতায় আসুক—আমাকে যেন আমার মতো করে সত্য কথা বলার স্বাধীনতা দেওয়া হয়।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *