লিভার ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন উদ্ভাবন

এসকে ফয়সাল আহমেদ। ৩১ অক্টোবর বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক জার্নাল নেচার সায়েন্টিফিক রিপোর্টস-এ প্রকাশিত হয় বাংলাদেশের স্থানীয় ভেষজ গাছ বিষকাটালি থেকে লিভার ক্যান্সারের চিকিৎসার সম্ভাবনা নিয়ে তাঁর গবেষণার কথা। বংশগত বিভিন্ন রোগ শনাক্তে সবচেয়ে কম খরচে মলিকুলার ডায়াগনস্টিকের সিস্টেম ডেভেলপমেন্টের কাজও করছে তাঁর গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডন অব বায়োইনফরমেটিক্স। তরুণ এই গবেষকের  স্বপ্নের পথে ছুটে চলার গল্প শুনেছেন ফাহিম আহমেদ 

দেশের স্থানীয় এক ভেষজ গাছ বিষকাটালি থেকে লিভার ক্যান্সারের চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছেন একদল তরুণ গবেষক। এই দলের প্রধান এসকে ফয়সাল আহমেদ। বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক জার্নাল নেচার সায়েন্টিফিক রিপোর্টস-এ ৩১ অক্টোবর প্রকাশিত হয় তাদের এই উদ্ভাবনের কথা। তরুণ এই গবেষক দল বায়োইনফরমেটিকস ও কম্পিউটেশনাল বায়োলজির সহায়তায় ভেষজ গাছ বিষকাটালির দুটি প্রাকৃতিক যৌগ শনাক্ত করেছেন, যা ভবিষ্যতে লিভার ক্যান্সারের ওষুধ উন্নয়নে নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচন করে দিতে পারে।  

যাদের হাত ধরে এলো এই উদ্ভাবন
প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা ডন অব বায়োইনফরমেটিক্স-এর গবেষণা দলের প্রচেষ্টায় এ সাফল্য এসেছে। গবেষণা দলের প্রধান ও ডন অব বায়োইনফরমেটিক্স-এর প্রতিষ্ঠাতা এসকে ফয়সাল আহমেদ। এছাড়াও গবেষণা দলটির অন্য সদস্যরা হলেন সানবিন সামিন, হাফিজা আখতার লাবনী, মো. ফাহিম ইসলাম, আজমিন আলম এলা, অমলেশ মণ্ডল, তিথি মণ্ডল। তাদের এই উদ্ভাবন সম্পর্কে জানতে চাইলে গবেষণা দলের প্রধান এসকে ফয়সাল আহমেদ বলেন, ‘লিভার ক্যান্সারের কোষ বেঁচে থাকতে নতুন রক্তনালির মাধ্যমে অক্সিজেন ও পুষ্টি গ্রহণ করে; যা ঘটে এনজিওজেনেসিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ভিইজিএফআর-২ নামের প্রোটিন, যা উৎপন্ন হয় কেডিআর জিন থেকে। আমাদের লক্ষ্য ছিল এই জিন বা প্রোটিনকে নিয়ন্ত্রণ করে ক্যান্সার কোষের রক্ত সরবরাহ বন্ধ করা। গবেষণার জিন স্তরে আমরা hsa-miR-17-3p নামের একটি মাইক্রোআরএনএ শনাক্ত করেছি, যা কেডিআর জিনের কার্যকারিতা দমন করতে পারে। প্রোটিন স্তরে বিষকাটালি গাছ থেকে প্রাপ্ত ১১৩টি প্রাকৃতিক যৌগ বিশ্লেষণ করে দুটি উপাদান–6-Hydroxyluteolin ও Isorhamnetin আবিষ্কার করেছি, যা ভিইজিএফআর-২ প্রোটিনের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করতে সক্ষম। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এই যৌগগুলো প্রচলিত ক্যান্সারের ওষুধ Sunitinib-এর তুলনায় বেশি কার্যকর ও কম ঝুঁকিপূর্ণ । এর মানে হচ্ছে প্রাকৃতিক উৎস থেকে পাওয়া এই উপাদানগুলো ভবিষ্যতে লিভার ক্যান্সারের বিকল্প ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।’

গবেষণায় কেন বিষকাটালি গাছ? 
গবেষণায় কেন বিষকাটালি গাছ বেছে নিলেন এই প্রশ্নের উত্তরে এসকে ফয়সাল আহমেদ বলেন, ‘বিষকাটালি একটি ভেষজ গাছ–এই ধারণা অনেকেরই আছে। আমাদেরও ধারণা ছিল। এর আগেও আমরা গাছটি নিয়ে কাজ করেছি। এছাড়াও আমাদের গবেষণা দলটি দীর্ঘদিন ধরে দেশীয় বিভিন্ন ভেষজ উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণা করে আসছে। বিশেষ করে বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের চিকিৎসা ও ওষুধ তৈরি আমাদের মূল গুরুত্বের জায়গা ছিল। দেশীয় বিষকাটালি গাছ থেকে পাওয়া এ ফলাফল আমাদের আত্মবিশ্বাস আরও বাড়িয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশে জন্মানো উদ্ভিদ থেকেই ভবিষ্যতে একদিন ক্যান্সারসহ আরও জটিল রোগের কার্যকর ওষুধ তৈরি সম্ভব হবে।’
তবে গবেষকরা জানিয়েছেন, এই গবেষণাটি এখন পর্যন্ত কেবল ইন সিলিকো বা কম্পিউটারভিত্তিক পর্যায়ে সম্পন্ন হয়েছে। এখন পরীক্ষার মাধ্যমে বাস্তব কোষ ও প্রাণীদেহে এর কার্যকারিতা যাচাই করা প্রয়োজন। ফলাফল ইতিবাচক হলে এটি হতে পারে কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াযুক্ত, প্রকৃতিনির্ভর ক্যান্সার চিকিৎসার এক নতুন অধ্যায়।  

যেভাবে শুরু
এসকে ফয়সাল আহমেদ নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বায়োটেকনোলজি ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে স্নাতক শেষ করে ২০২২ সালে ঢাকায় এসে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। এরই মধ্যে গতানুগতিক চাকরির পেছনে না ছুটে গবেষণাকে ভালোবেসে একই বছর নিজেই খুলে ফেলেন গবেষণাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান–ডন অব বায়োইনফরমেটিক্স লিমিটেড বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ডন অব বায়োইনফরমেটিক্স লিমিটেড বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ফার্মাসিউটিক্যাল ও ডায়াগনস্টিক কোম্পানি কিংবা গবেষণা সংস্থাগুলোকে বায়োলজিক্যাল ডেটা অ্যানালাইসিসসহ বিভিন্ন সেবা দিয়ে আসছে। তবে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কাজের ক্ষেত্র হলো মেডিকেল ডায়াগনস্টিক ডেটা অ্যানালাইসিস, ড্রাগ ও ভ্যাকসিন ডিজাইন এবং ডেভেলপমেন্ট বিভিন্ন মলিকুলার সিকুয়েন্সিং ডেটা অ্যানালাইসিস। বিভিন্ন ইন্টারন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল ও রিসার্চ গ্রুপকে ড্রাগ ও ভ্যাকসিন ডেভেলপমেন্টের প্রাথমিক সহায়তাও করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়াও বায়োইনফরমেটিকসের বিভিন্ন সাব-ফিল্ড, যেমন-জিনোমিক্স, মেটাজেনোমিক্স, প্রোটিওমিক্স ও ট্রান্সক্রিপ্টমিক্স-এর বিভিন্ন ডেটা অ্যানালাইসিসের কাজও এখানে করা হয়। বর্তমানে তাদের ৪০টির বেশি বায়োইনফরমেটিক্স সংবলিত বিভিন্ন সার্ভিস, ১৫টির মতো পেশাদার বায়োইনফরমেটিক্স ট্রেনিংসহ বিভিন্ন সেবা রয়েছে। 

আন্তর্জাতিক গবেষণায় সাফল্য
গবেষণা দলের প্রধান এসকে ফয়সাল আহমেদ আন্তর্জাতিকভাবে আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় ভূমিকা রেখেছেন। তার একটি গবেষণা PLoS ONE (2025) জার্নালে প্রকাশিত হয়, যা ট্রিপল নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিকিৎসায় ভারতীয় ১১টি ভেষজ উদ্ভিদ থেকে PD-L1 inhibitor যৌগ শনাক্ত করেছে। এতে দেখা যায়, প্রাকৃতিক উৎস থেকে সংগৃহীত কিছু যৌগ প্রচলিত ওষুধের তুলনায় কম বিষাক্ত এবং বেশি স্থিতিশীলভাবে ক্যান্সার প্রোটিনকে বাধা দিতে পারে। অন্যদিকে জার্নাল অব জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এবং বায়োটেকনোলজি-২০২৫-এ প্রকাশিত আরেকটি প্রবন্ধে তিনি ও তাঁর গবেষণা সহকারীরা, যষ্টিমধু উদ্ভিদের দুটি উপাদান– Licoisoflavone B ও Glabridin -কে Lassa virus প্রতিরোধে সম্ভাব্য ওষুধ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এতে উন্নত কম্পিউটারভিত্তিক মডেল ব্যবহার করে ভাইরাস প্রোটিন-লিগ্যান্ড পারস্পরিক ক্রিয়া বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

২০২১ সালে সায়েন্স ডাইরেক্ট-এ প্রকাশিত আরেকটি গবেষণায় তিনি স্নায়বিক রোগের চিকিৎসায় আয়ন কো-ট্রান্সফোর্টারের ভূমিকা নিয়ে কাজ করেন, যা পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক ডেটাবেসে উদ্ধৃত হয়েছে। এছাড়াও তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকে ইতোমধ্যে ১২টির মতো গবেষণাপত্র বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে এবং ২০ এর অধিক গবেষণা চলমান রয়েছে।

আগামীর ভাবনা
আগামীর ভাবনার বিষয়ে জানতে চাইলে ফয়সাল আহমেদ বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা চাই বায়োইনফরমেটিকসের সহায়তায় দেশে ও দেশের বাইরে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন মরণব্যাধি রোগের সহজলভ্য শনাক্তকরণ পদ্ধতি আবিষ্কার এবং ড্রাগ ও ভ্যাকসিন ডিজাইন, ডেভেলপমেন্টের মাধ্যমে তা সমাধান করতে। এছাড়াও ইতোমধ্যে আমরা দেশের মেডিকেল সেক্টরে সবচেয়ে কম খরচে মলিকুলার ডায়াগনস্টিকের সিস্টেম ডেভেলপমেন্টের কাজটি হাতে নিয়েছি। আমরা আশা করছি, আগামী বছরের মধ্যেই এটি সম্পূর্ণ করতে পারবো। এতে রোগীরা বর্তমানের অর্ধেক খরচে তাদের বিভিন্ন বংশগত রোগ শনাক্ত করতে পারবেন। এ ছাড়া এরই মধ্যে আমাদের সঙ্গে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক কোম্পানি ও সংস্থার যৌথ গবেষণার কথাও হয়েছে, যা বাস্তবায়িত হলে গবেষণায় আগ্রহী তরুণরা দেশেই বড় বড় গবেষণায় ভূমিকা রাখতে পারবেন।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *