রাসলীলা ও মণিপুরি নারী

একটি জাতিকে বোঝার ক্ষেত্রে তার সংস্কৃতিকে জানা-বোঝা খুবই জরুরি। আমাদের আলোচনার প্রসঙ্গ, একটি পরিবেশনা ও তার সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্য দিয়ে একটি বিকশিত সমাজে নারীর অবস্থান বিশ্লেষণ: প্রেক্ষিত মণিপুরি জনগোষ্ঠী। 

সংস্কৃতি বলতে আসলে কী বুঝি, তার দিকে একটু নজর দেওয়া যাক। এ প্রসঙ্গে সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা এডওয়ার্ড বার্নেট টাইলর বলেন, সংস্কৃতি হলো সমাজে সেই প্রক্রিয়া বা ব্যবস্থা যা সমাজের প্রথা, ধর্মীয় বিশ্বাস, নৈতিকতা, চারুকলা, আইনব্যবস্থা ইত্যাদির সমন্বয়ে তৈরি। সমাজবিজ্ঞানী রেমন্ড উইলিয়ামসের চিন্তাধারাও এখানে প্রাসঙ্গিক। তিনি তিনটি আন্তঃসম্পর্কিত প্রক্রিয়া দিয়ে সংস্কৃতিকে ব্যাখ্যা করেন। প্রথমটি, বুদ্ধিবৃত্তিক, আধ্যাত্মিক ও নান্দনিক বিকাশের একটি সাধারণ প্রক্রিয়া; দ্বিতীয়টি, নির্দিষ্ট জীবনধারা এবং তৃতীয়টি, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং বিশেষ করে শিল্পকলা-সংক্রান্ত কাজ ও অনুশীলন। মণিপুরি সমাজ ও সংস্কৃতিকে এ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। 
প্রথমত, মণিপুরিরা সহজিয়া বৈষ্ণব ধর্মের প্রবক্তা চৈতন্যদেবের অনুসারী, যেখানে ভক্তিভাব, ভক্তিধর্মের প্রসার, সাহিত্য ও সংগীতে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলার প্রাধান্য পেয়েছে। রাধা-কৃষ্ণ সমার্থক হিসেবে নর-নারী প্রেমের ভাবকে ভক্তি ও আধ্যাত্মিকতার মধ্য দিয়ে অনুভব করার এক তরিকা মণিপুরিরা অনুসরণ করে।

দ্বিতীয়ত, সনাতন ধর্মাবলম্বী মণিপুরি সমাজে কেবল দুটি বর্ণের উপস্থিতি রয়েছে। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়। চৈতন্যদেবের প্রচারিত বৈষ্ণবধারায় অনুসারী এই জনগোষ্ঠী রাধাকৃষ্ণের ভজনাই প্রধান ধর্মীয় আচার হিসেবে চর্চা করে। আবার হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়ার কারণে হিন্দুধর্মের গুরুত্বপূর্ণ দেবদেবীর ‍পূজা যেমন দুর্গাপূজা, সরস্বতী পূজা, লক্ষ্মীপূজা, শিবপূজা, বিশ্বকর্মাপূজা ইত্যাদিও করে থাকে। এ ছাড়া রয়েছে তাদের আদিধর্ম। ফলে মণিপুরি সংস্কৃতিতে বিভিন্ন ধরনের ক্রিয়া বা আচারের সংমিশ্রণ রয়েছে; যা এই জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে করেছে উদার ও বিচিত্র। ফলে একটি বর্ণিল স্বকীয় জীবনধারা আমরা মণিপুরি সমাজে দেখতে পাই।

তৃতীয়ত, মণিপুরিরা শান্তিপ্রিয়, ধার্মিক এবং কলাপ্রিয়। নিজস্ব আঙ্গিকে ধর্মীয় অনুষ্ঠানসমূহ পালন করে। প্রতিটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যেসব কৃত্য পালন করে তাতে সংগীত, তাল, লয়, মুদ্রা ও বাদ্য অবশ্যম্ভাবী অংশ। তা সুনির্দিষ্ট, নিয়ন্ত্রিত, ধ্রুপদি। বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ-পরবর্তীকালে রাসলীলা, নটপালা, রাখালরাস, খুবাকঈশৈ, নুপীপালা, ধ্রুমেল এসব পরিবেশনায় চেতনা, তত্ত্ব, চর্চা খুব গূঢ়ভাবে নিহিত থাকে। রাধা-কৃষ্ণের বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি এবং উপকথাগুলোর প্রতি মণিপুরীদের শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাস থেকে মণিপুরের নৃত্যসংগীতের উপকরণ সংগৃহীত হয়েছে। রাসলীলার প্রধান উপাদান হচ্ছে নৃত্য, গীত ও নাট্য। মণিপুরি নৃত্যের মূল ভিত্তি হচ্ছে এই রাসলীলা।

রাসলীলা কী? রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার এক নৃত্যগীতাভিনয় পরিবেশনা এই রাসলীলা। রাধাকৃষ্ণের এই লীলা দেখার মধ্য দিয়ে পরমকে পাওয়ার সাধন করা হয়। এখানে কৃষ্ণ হলো পরমাত্মা ও রাধা হলো জীবাত্মা। জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার মিলনের মধ্য দিয়ে জীবের মুক্তি ঘটে। কৃষ্ণ হচ্ছে একমাত্র পুরুষ এবং বাকি জীবসত্তার সকলেই নারী। সমাজের সকল মানুষ নারীসত্তাকে ধারণ করে রাধাভাবে কৃষ্ণকে ভজনা করছে— এই হচ্ছে মণিপুরিদের ও দর্শন। তাই পরমাত্মাকে অনুভব করার জন্য রাসলীলা দেখা একটা পুণ্যকর্ম বলেও মনে করে তারা।

কী ঘটে থাকে এই রাসলীলা পরিবেশনায়?
একটি রাসে প্রথমে রাসধারী (রাস পরিচালনাকারী) ও সূত্রধারী নির্ধারিত রাগালাপ করেন। এরপর কারুকাজখচিত নৃত্যপোশাকে সুসজ্জিত বৃন্দা চরিত্র সাজানো কুঞ্জে প্রবেশ করে। মণিপুরি রাসলীলায় যার মানসে একটি রাস আয়োজন করা হয় সে-ই বৃন্দারূপে নৃত্য প্রদর্শন করে। সে এসে প্রথমেই নাচের মধ্য দিয়ে বৃন্দাবনরূপী কুঞ্জকে সাজায়। কারও কারও মতে, বৃন্দা চরিত্রটি আমাদের মানবের সৃষ্টি একটি কাল্পনিক চরিত্র, আমরা কৃষ্ণকে যেভাবে পেতে চাই সেই নির্মোক ভাবের একটি ভাব হচ্ছে বৃন্দাভাব, কৃষ্ণের সাথে এই বৃন্দার কখনও দেখা হয় না, যেমন হয় না ঈশ্বরের সাথে মানবের, তবুও মানুষ সেই পরমের কাছে নিজেকে যেভাবে সমর্পণ করে বৃন্দাও নিজেকে কৃষ্ণের কাছে সেইভাবে সমর্পণ করে। আবার কারও মতে এই বৃন্দা হলো যোগমায়ার আরেক রূপ, যে কৃষ্ণের সাথে রাধা তথা গোপীর সাক্ষাৎ ঘটিয়ে দেন (তথ্য: রাসধারী এবং সূত্রধারী কৃষ্ণকুমারী দেবী ও থৈবী দেবী)।

পুরাণে উল্লেখ আছে, কৃষ্ণ এই রাসলীলায় সমস্ত রকমের অঘটন সংঘটন করার জন্য অচিন্ত্য মহাশক্তির স্বরূপা যোগমায়াশক্তি প্রকাশ করেছিলেন। এই যোগমায়ার মাধ্যমেই কৃষ্ণ তার রাধা ও গোপীর সাথে রাসলীলা করেন। এই রাসলীলার কৃষ্ণের বিভিন্ন পদে আমরা তার উল্লেখ পাই, ‘যোগমায়া আরাধিয়ে, মোহন বাঁশী হাতে লয়ে/ রাধার সঙ্গে বিলাসিতে, যাইতে শ্রীবৃন্দাবনে’। রাধাকৃষ্ণ মিলনের জন্য এই যোগমায়ার বিরাট ভূমিকা রয়েছে। বৃন্দানৃত্য সমাপ্ত হলে কুঞ্জে প্রবেশ করে কৃষ্ণরূপী বালক। মণ্ডলী ঘুরে ঘুরে সে নৃত্য করে। গীত ও নৃত্যের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় সে বৃন্দাবনে যাচ্ছে গোপীদের সাথে লীলা করতে। এ পর্যায়ে নৃত্য শেষে, কৃষ্ণ মণ্ডলীর পূর্বদিকে বৃন্দাদেবীর সাজানো আসনে বিশ্রামের জন্য দাঁড়ায়। পরে রাধাসহ গোপীদের প্রবেশ ঘটে। রাধা এবার কৃষ্ণের অভিসারে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন সাজে সজ্জিত হতে শুরু করে। পরিবেশনার পর্যায়ক্রমে আসে রাধা ও সখীর বংশী অনুরাগ, সাজল, যাত্রা অভিসার, বাউল অভিসার, বনভ্রমণ, যুগলরূপ প্রার্থনা, পুনর্নর্তন, নর্তন, ভঙ্গীপারেং, অন্তর্ধান, কৃষ্ণনর্তন, রাধানর্তন, রাসবিশ্রাম, আরতি, গৃহগমন। আরতিতে কৃষ্ণ ও রাধার যুগলরূপকে বন্দনা করা হয়। রাতজুড়ে এই রাসলীলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। রাত এগারোটা/বারোটায় শুরু হয় এবং ভোর অবধি চলে। 

অন্তর্ধান পর্বে রাসলীলায় রাসমণ্ডল থেকে কৃষ্ণ কেন হঠাৎ অন্তর্ধান করে? 
ভক্ত ও রাসধারীদের কাছ থেকে জানা যায়, এই ব্যাপারটি না থাকলে ভক্তিপ্রেমকে ঈশ্বর জনসমাজে বোঝাতে পারতেন না। তিনি প্রকৃতির আবরণে, জীবের কামনা-বাসনার অন্তরালে লুকিয়ে আছেন ধরা দেওয়ার জন্য। জীব তন্ময় হয়ে যখন তার খোঁজ করবেন তখনই তিনি ধরা দেবেন। সব জীবের মধ্যেই লুকিয়ে আছে রাধা। যিনি আরাধনা করেন তিনিই রাধা। আর পরকীয়া হচ্ছে প্রকৃতি বা সংসার। সংসারকে তুচ্ছ করে রাধা যেমন কৃষ্ণের প্রেমের জন্য পাগল হয়ে ছুটে যায়, তেমনি এই জগৎকে ভুলে পরমাত্মাকে পাওয়ার জন্য জীবাত্মার ছুটে চলা– রাসলীলার গুপ্তরহস্য হচ্ছে এই। 

কৃষ্ণ বিনা রাধা অপূর্ণ, তেমনি ভক্তমনে কৃষ্ণেরও পরম সত্তার পূর্ণতা রাধা-মিলনের মধ্য দিয়ে। লীলার এই বার্তা সমাজে আরেকটি তাৎপর্য তৈরি করে— নারী আর পুরুষের অহংলুপ্ত মিলন জীবনের পরিপূর্ণ অর্থানুসন্ধানে প্রেরণাশক্তি হয়। এক নারী রাধার মধ্য দিয়ে পরমপুরুষ কৃষ্ণকে অনুভব করার দার্শনিক চেতনা, কৌম সমাজের লিঙ্গীয় ভারসাম্য রক্ষায় সহায়ক হয়ে ওঠে। অর্থাৎ রাসলীলা পরিবেশনার মধ্য দিয়ে বোঝা যায় মণিপুরিদের সমাজ-চেতনার দর্শন। নারী-পুরুষ একজন যে অপরের পরিপূরক, নারী যে নিগৃহীত সত্তা নয়, পরিবারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর মতামতকে বিবেচনা করা, সম্মান করা, নারীর দৃষ্টিভঙ্গিকে মূল্যায়ন করার চেতনা জাগায় এই রাসলীলার তত্ত্ব ও চর্চা। ফলে মণিপুরি সমাজে নারী-পুরুষের সম্পর্ক এক ধরনের সমতা বজায় থাকে।

রাসলীলা মূলত নারীকেন্দ্রিক পরিবেশনা 
মণিপুরিদের প্রথম রাসলীলা অনুষ্ঠিত হয় মণিপুরে ১৭৭৯ খ্রিষ্টাব্দে মহারাজা ভাগ্যচন্দ্র সিংহের আয়োজনে। স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে নিজকন্যা রাজকুমারী সীজালাই ওনবী বা বিম্বাবতী দেবীকে রাধার ভূমিকায় সাজিয়ে এই রাসলীলার আয়োজন করেন। গানের বেশির ভাগ গীতিকবিতা মৈথিলী এবং ব্রজবুলি ভাষার। এর সঙ্গে মণিপুরি সংগীতের নিজস্ব গায়কি ও হস্ত-পদমুদ্রাবিক্ষেপে এই পরিবেশনা পরিবেশিত হয়। মণ্ডলীর ভেতরে কেবল কৃষ্ণ বাদে এই পরিবেশনার সকল শিল্পীই নারী। রাধা ও কৃষ্ণ চরিত্রের জন্য পাঁচ থেকে আট বছরের বালিকা ও বালককে নির্বাচিত করা হয়। 

এর কারণ জানান শিল্পী চন্দ্রমোহন। “যেহেতু রাধা-কৃষ্ণ প্রেমের প্রতীক এবং তাদের একজন পরমাত্মা আরেকজন জীবাত্মা, একইসঙ্গে আমরা পরমাত্মাকে পেতে চাই নিষ্কামভাবে, তাই পরমাত্মার প্রতীককে এমন একটা দৃশ্যগত রূপ দেওয়া হয় যাকে দেখলে ভক্তবৃন্দের মধ্যে কিংবা যে অভিনয় করছে তার মনে কোনোপ্রকার কামভাব না জন্মায়। যে রস ও ভাবকে অনুভবে পেতে চাই একটা শিশু সেই ভাবকে ধারণ করতে সক্ষম। তাই রাসলীলায় রাধা ও কৃষ্ণের ভূমিকায় শিশুরা অংশগ্রহণ করে। শিশুদের দেখে আমাদের ভক্তিভাব উদয় হয় এবং পুরো রাসলীলা আমরা উপভোগ করি। তাই এই রাসলীলা দেখা বা করা আমাদের জন্য একটি পুণ্যের কাজ।”

রাসলীলা মনের সকল কামনা-বাসনা বর্জন করে দর্শন করতে হয়। অধি-দৈহিক নর-নারী সম্পর্কের আধ্যাত্মিক চর্চা সমাজে নারীকে শরীরমাত্র করে দেখার চর্চা থেকে পুরুষকে বিরত রাখে। আবার রাসলীলার পোশাক পরিচ্ছদও খুবই শৈলীময়, নান্দনিক, কারুকাজখচিত, রাজকীয়। প্রাত্যহিক বা সমাজজীবনে ব্যবহৃত পোশাকী কোনো চিহ্ন সেখানে নেই। রাসলীলায় ব্যবহৃত পোশাক পরিহিত নারীর কোমল পদবিক্ষেপে ও হস্তমুদ্রায় নৃত্য যে কোনো ভক্তমনে নারীকে একটি আলাদা স্বর্গীয় মর্যাদা দিতে বাধ্য। পুরুষমনে নারীর প্রতি একটি সম্মানবোধ জেগে ওঠে।

মণিপুরি সমাজে একটি পরিবারের সন্তান ছেলে কিংবা মেয়ে উভয়েই ছোটবেলা থেকে রাসলীলাসহ এই সকল পরিবেশনা দেখে, অংশ নেয়। রাত থেকে ভোর অবধি প্রায় ছয় ঘণ্টা চলে পরিবেশনা। 

বাংলাদেশে নারীর অবস্থান ও অবদান – দুইই উপেক্ষিত। মণিপুরি সমাজে নারী-অধিকার ও অবস্থান যথেষ্ট জোরালো। নারী অধিকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো শিক্ষার সমান সুযোগ। নারীরা যখন শিক্ষার সমান সুযোগ পায়, তখন তারা নিজেদের এবং তাদের পরিবারের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে পারে। অধিকাংশ মণিপুরি নারী শিক্ষিত, শিক্ষার হার নারী-পুরুষ উভয়ের প্রায় সমান বললেই চলে, সফলতার সাথে নারী পুরুষের পাশাপাশি বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। কৃষিকাজ, পশুপালন ইত্যাদি কাজে নারীরা স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে। এ ছাড়া মণিপুরি তাঁতশিল্প বিকাশে মণিপুরি নারীর ভূমিকা অগ্রগণ্য, আত্মনির্ভরশীল হওয়ার প্রচেষ্টা থাকে সর্বদা। সামাজিক ক্রিয়াকর্মে তাদের অংশগ্রহণ থাকে সাবলীল। একটি জনগোষ্ঠীর সার্বিক অগ্রগতি ও উন্নয়নে সংস্কৃতি কীভাবে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে এবং নারী-পুরুষের সমতা আনয়নে কিরূপ ভূমিকা রাখতে পারে– মণিপুরি জনগোষ্ঠীর জীবনচর্চা তার একটি অনন্য উদাহরণ হতে পারে, রাসলীলা যার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *