কিশোর, মুসা, রবিন এই তিনটি নাম একসময় ছিল আমার ছোট্ট পৃথিবী। তারা রক্ত মাংসের মানুষ না থাকলেও, ছিল আমার কল্পনার জগতের বাসিন্দা। বিশ্বাস করতাম- ওরা আছে। রকি বিচ নামের একটা শহরে, তাদের একটা গুপ্ত গোয়েন্দা অফিস আছে, সেটা স্ক্র্যাপইয়ার্ডে লুকোনো, আর তারা যেন এখনি কোনও এক রহস্যভেদে বেরিয়ে পড়বে।
আমি তখন স্কুল পড়ুয়া। স্কুল শেষে, স্কুলের শেষ বেঞ্চে পাঠ্যবইয়ের মাঝে লুকিয়ে কিংবা রাতের বেলা চুপিচুপি পড়তাম তিন গোয়েন্দা। একদিকে সচেতন থাকতে হতো কেউ যেন টের না পায়, গল্পের বই পড়ছি। অন্যদিকে আমার কল্পনায় ভেসে যাচ্ছে কিশোরের বুদ্ধিদীপ্ত চোখ কিংবা মুসার হাস্যোজ্জ্বল চেহারা।
তখন কেবল পড়া শিখছি বলা যায়, তখন হাতে ওঠে ‘ভয়ংকর অসহায়’ বইটি। কিন্তু সেই বইয়ের কালো মোটা অক্ষরের মধ্যে এমন এক রহস্য আর রোমাঞ্চ ছিল প্রতিটি লাইনে, সেখান থেকে চোখ সরাতে পারিনি।
তখনও জানতাম না যে, সিরিজের পেছনে এক আশ্চর্য ইতিহাস আছে। তিন গোয়েন্দার মূল ভিত্তি কিন্তু বাংলাদেশের সৃষ্টি নয়। রবার্ট আর্থারের ‘দি থ্রি ইনভেস্টিগেটর’ অবলম্বনে রচিত। সেসব চরিত্রের নাম ছিল Jupiter Jones, Pete Crenshaw আর Bob Andrews। কিন্তু রকিব হাসান সেটারই বাংলা ছায়া নিয়ে আমাদের উপহার দিল এক নতুন রূপে ‘তিন গোয়েন্দা’।
এটাও জানতাম না যে, এই তখনকার তরুণ লেখক শামসুদ্দীন নওয়াব (ছদ্মনাম), পরে যিনি পরিচিত হন রকিব হাসান নামে। তিনিই তিন গোয়েন্দার প্রাণসঞ্চার করেন বাংলা ভাষায়। বড় হয়ে জেনেছি সব, কিন্তু মন জুড়ে রয়ে গেছে ছেলেবেলার সেই সব স্মৃতিকাতরতা।
রকি বিচ। শহরটা চোখে দেখা নয়। কিন্তু তবুও কতো পরিচিত ছিল। ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূলবর্তী এক ছোট্ট শহর। যেখানে কিশোর, মুসা আর রবিনের প্রতিটি অভিযান শুরু হতো। তিন গোয়েন্দার ঘাঁটি ছিল পুরোনো এক স্ক্র্যাপইয়ার্ডে। যেখানে গুপ্ত অফিসে ঢোকার জন্য ছিল গোপন দরজা- বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে রোমাঞ্চে শিহরিত হতাম। মনে হতো যেন আমিও আছি ওদের সাথে অভিযানে।
কিশোর থাকত রাশেদ চাচা ও মেরী চাচীর সাথে। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক ছিল সে। মুসা আমান ছিল আমেরিকান নিগ্রো। রসবোধসম্পন্ন ও খেলাধুলায় পারদর্শী। আর রবিন মিলফোর্ড ছিল আইরিশ। সবসময় বইয়ের ভেতর ডুবে থাকতে পছন্দ করতো। দুর্বল স্বাস্থ্যের হলেও সাহসিকতায় কম যেত না। তাদের যেকোন অভিযানেই থাকত রহস্যময় মানুষ, ছায়ার মত লুকিয়ে থাকা শত্রু, রহস্যাবৃত বাড়ি কিংবা প্রাচীন কাহিনি। আর প্রতিবারই তারা প্রমাণ করত বুদ্ধি, বন্ধুত্ব আর সাহস দিয়েই সব জয় করা যায়।
মগবাজার রেলগেট, মধুবাগ আর বনশ্রীতে নির্দিষ্ট বইয়ের দোকান ছিল। সবসময় সেখানে খোঁজ রাখতাম- কবে নতুন বই আসবে। সাথে সাথে যেন কিনতে পারি- সেজন্য টিফিনের টাকা থেকে জমিয়ে রাখতাম বই কেনার টাকা। স্কুলে নতুন কোনও বই একজন নিয়ে আসলে কতক্ষণ তার থেকে নিয়ে বইয়ের পেছনের মলাটের সারসংক্ষেপ পড়বো, তার অপেক্ষায় এক অসহ্য আবেগ কাজ করতো। এছাড়াও একে অপরের কাছ থেকে আদান-প্রদান করে পড়তাম। একেকটা বই পড়া মানেই যেন একেকটা অভিযান শেষ করা। আর প্রতিবারই শেষ পাতায় এসে মনে হতো- ‘ইসসস, আরও থাকলে ভালো হতো!’
তিন গোয়েন্দার ভূত এতটাই মাথায় চেপেছিল যে- স্কুলে আমরা চিঠি চালাচালি করতাম কোড ব্যবহার করে। এমনকি ‘গোপন সংকেত’ও বানিয়েছিলাম। কেউ না জানলেও আমরা নিজেদের চোখে নিজেদের সত্যিকারের গোয়েন্দা মনে করতাম। আর এর সব কিছুর মূলে ছিল একমাত্র তিন গোয়েন্দা। রকিব হাসান আমাদের কল্পনার জগতে আরও রঙ ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করেছিল।
মূলত তিন গোয়েন্দা ১৯৮৫ সালে যাত্রা শুরু করে। শুরুতে ইংরেজি সিরিজের অনুবাদ হলেও পরে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আস্তে আস্তে পরিবর্তন করে লেখেন রকিব হাসান। যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলসের পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডে লুকানো তিন গোয়েন্দার হেড কোয়ার্টারটি একটি পুরো প্রজন্মের কৈশোরকে আবদ্ধ করে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। ১৯৮৫ থেকে ২০০৩ অব্দি রকিব হাসান ১৫৮টি তিন গোয়েন্দার কাহিনী লেখেন। কঙ্কাল দ্বীপ, রুপালি মাকড়সা, অপারেশন কক্সবাজার, মায়া নেকড়ে, প্রেতাত্নার প্রতিশোধ, রুদ্র সাগর, খেপা শয়তান সহ অসংখ্য জনপ্রিয় পর্ব আজও পাঠকের মনে গেঁথে আছে।
তিন গোয়েন্দার লেখক রকিব হাসান
তবে একটা সময় পর সিরিজটির জনপ্রিয়তা কিছুটা কমে এলেও, যে প্রজন্ম তিন গোয়েন্দা নিয়ে বড় হয়েছে- তাদের মনে তিন গোয়েন্দার জায়গা আজও অম্লান।
এখনকার শিশুরা হাতে পায় ট্যাব, ইউটিউব আর গেমিং অ্যাপস। কিন্তু আমাদের সময় ছিলো একটা বই আর একগুচ্ছ কল্পনা। তিন গোয়েন্দা আমাদের কৈশোর মনে দু:সাহস, কৌতূহল আর সততার বীজ বুনে দিয়েছিল। তখন আমরা বুঝিনি, এই বইগুলো আমাদের নৈতিকতা, বন্ধুত্ব আর নির্ভীকতা শিখিয়ে দিচ্ছে। শুধু জানতাম- পরের পর্ব কবে আসবে!
আজ আমি চাকরি করি, জীবনযাপনের ব্যস্ততা আছে- তবু একেকটা পুরোনো বই খুললে মনে হয় ফিরে গিয়েছি সেই পুরোনো দিনে। মাঝে মাঝে বুকশেলফে চোখ যায়। দেখি একটা মলিন মলাটের তিন গোয়েন্দা বই পড়ে আছে। ছুঁয়ে দেখি। হাত বুলিয়ে দিই প্রচ্ছদে। মনে হয়, ফিরে গেছি – কৈশোরের দিনগুলোতে।
জীবনে কত কিছু বদলায়। স্কুল শেষ হয়, বন্ধু হারিয়ে যায়, পছন্দের জিনিস বদলে যায়। কিন্তু তিন গোয়েন্দা? তারা আছে। তারা আমার শৈশবের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো। যারা বদলায় না, ভুলে যায় না, আর যাদের কাছে ফিরে গেলে আমি নিজের ছোটবেলাটাকেই আবার ছুঁয়ে দেখতে পাই।