ট্রাম্প নিজেই এক হরর গল্প

গার্ডিয়ানের পাঠকের বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন হরর উপন্যাসের জীবন্ত কিংবদন্তি মার্কিন লেখক স্টিফেন কিং। কিংয়ের স্বতঃস্ফূর্ততা ও স্বভাবসুলভ কৌতুকপ্রবণতার অনুপম উদাহরণ এই সাক্ষাৎকার। ১৩ আগস্ট ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানে প্রকাশিত।
গ্রন্থনা : রিচ পেলি
অনুবাদ : তারেক মিনহাজ

প্রশ্ন: আপনি কি এখনও বইয়ের দোকানে গিয়ে, কেউ না দেখলে, নিজের বইগুলোতে সই করে রেখে আসেন? 
স্টিফেন কিং: যদি লুকিয়ে ঢোকা-বার হওয়া যায়, তাহলে করি। শেষবার আমি এটা করেছি আমার বাড়ির কাছেই পশ্চিম মেইনের একটা বইয়ের দোকানে– সেখানে ‘নেভার ফ্লিঞ্চ’ আর ‘ইউ লাইক ইট ডার্কার’-এর কিছু কপিতে সই করে রেখেছিলাম। আমি আসলে বই সই দিতে খুব পছন্দ করি না, কারণ সবারটা করা যায় না। আমার শেষ বই সফরে আমাকে ১,০০০ কপির মধ্যে এলোমেলোভাবে বাছাই করা ৪০০ কপিতে সই করতে হয়েছিল, তাই স্বাক্ষর পাওয়াটা ছিল ভাগ্যনির্ভর। কিন্তু এটা অন্তহীন লাইন সামলানোর চেয়ে ভালো ছিল, যেখানে প্রত্যেকে দুই-তিনটি বই নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সেটা বেশ কঠিন।
l“প্রলিফিক” (বহুপ্রজ) শব্দটা অনেক সময় বাড়াবাড়ি করে ব্যবহার করা হয়, কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে তা নয়। থেমে না যাওয়া কি আপনার ইচ্ছা, নাকি থামতেই পারেন না? 
llসকাল ৯টা থেকে দুপুর পর্যন্ত প্রতিদিন যে অতিরিক্ত দুই-তিন ঘণ্টা পাই, সেটা নিয়ে কী করব– এটা ঠিক করাই কঠিন। টিভিতে তো আর এত গেম শো দেখা যায় না। হাঁটতে বেরোতে পারি, কিন্তু তখনও পরের কাজটাই ভাবি। আসলে ভাই, আমি নিজেকেই বিনোদন দিচ্ছি।
lজিনিস যত বেশি পা-ওয়ালা হয়, ততই কেন বেশি ভয়ের মনে হয়? 
llএর মধ্যে কিছুটা সত্য আছে। আমি সদ্য ব্রিটিশ ফ্যান্টাসি উপন্যাস ‘সিটি অব লাস্ট চান্সেস’ পড়লাম, আদ্রিয়ান চাইকোভস্কির লেখা। সেখানে একটা দানব আছে মাটির গর্তে, যা এক ধরনের শতপদীর মতো– অনেকগুলো পা। যখন কাউকে সেই গর্তে ফেলে দেওয়া হয়, দানবটি তার সব পা দিয়ে ধরে, চামড়া ভেদ করে, আর মাথা চিবিয়ে খেয়ে ফেলে। সত্যিই ভয়ংকর ছিল। ব্যাপারটা হলো, ওরা দেখতে আমাদের মতো নয়। ওরা মূলত এলিয়েন-সদৃশ প্রাণী। কিছুটা ভয়ের হওয়াই স্বাভাবিক।
lআমি ইংরেজিতে মাস্টার্স করছি এবং আমার গবেষণার বিষয় হোলি গিবনির চরিত্র কীভাবে খণ্ড-খণ্ড ভূমিকায় থাকা অবস্থা থেকে সাতটি বইজুড়ে প্রধান চরিত্রে পরিণত হয়েছে– এ নিয়ে। আপনি কি সাহায্য করতে পারেন? 
llআমি একরকম ওর প্রেমেই পড়ে গিয়েছিলাম। তাকে প্রায় রসিকতার মতো একটা চরিত্র ভাবা হয়েছিল; বলতে গেলে একপাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া চরিত্র। সে তার মায়ের আধিপত্যে খানিকটা দমে থাকা মানুষ– মা ছিল খুব কর্তৃত্বপরায়ণ, আর বাবা ছিলেন একেবারে নরম-সরম, প্রায় যেন কাপড়ের টুকরো। ‘মিস্টার মার্সিডিজ’ বইটায় এক পর্যায়ে জেরোম রবিনসন হোলির কাছে যায়, কারণ সে কম্পিউটার বোঝে, আর ওদের মধ্যে যেন একটা ক্লিক হয়। ওই মুহূর্তেই সে তিনমাত্রিক চরিত্রে রূপ নিতে শুরু করে। যত বেশি আমি তাকে নিয়ে লিখেছি, যত বেশি আগ্রহী হয়েছি, সে ততই আত্মবিশ্বাসী আর আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। এখনও তার মধ্যে হীনম্মন্যতা আছে, আর সে বিবাহিত নয়, প্রেমিকও নেই। আমার মনে হয়, সে হয়তো কুমারী। আমি নিশ্চিত নই। তার অতীত পুরো খুঁটিয়ে দেখিনি। কিন্তু সে আমাকে খুবই আকর্ষণ করেছে। তৃতীয় উপন্যাসে এসে তো সে গল্পে ঢুকেই পুরো বইটাই দখল করে নিয়েছিল।
lআমি একটা আর্টস স্কুলে পড়ি এবং ভবিষ্যতে হরর লেখক হতে চাই। অনুপ্রেরণা পাওয়ার জন্য কী ধরনের পার্টটাইম কাজ ভালো হবে? 
llআমি একটা মিলে কাজ করার সময় অনুপ্রেরণা পেয়েছিলাম। আমাদের জায়গাটা পরিষ্কার করতে হতো, আর বেজমেন্টে বিশাল বিশাল ইঁদুর ছিল। আমি সে নিয়ে একটা গল্প লিখেছিলাম, আর তারপরই আমি ছুটে চললাম। আমার মনে হয় যে কোনো ধরনের শ্রমের কাজ– যা আমেরিকায় আমরা ব্লু-কলার কাজ বলি– একজন লেখকের জন্য খুব ভালো অভিজ্ঞতার জোগান দিতে পারে। এমন কাজ ভালো নয় যেখানে পরিষ্কার, আলো-জ্বলা ঘরে বসে থাকতে পারবে এবং কিছু খারাপ জিনিস পরিষ্কার করতে হবে না।
lযদি ভয় একটা রং হতো, সেটা কি একরঙা হতো, নাকি নানা শেড থাকত? 
llআমার মনে হয় সেটা গাঢ় নীল, যা ধীরে ধীরে কালোর দিকে ঢোকে। একটু রং থাকতেই হবে– কারণ আপনাকে কিছুটা দেখতে হবে। ছায়ায় কী আছে, সে সম্পর্কে কিছুটা আন্দাজ পাওয়ার দরকার হয়। তাই হ্যাঁ– আমি বলব, গাঢ় নীল থেকে কালো।

lযদি আপনাকে “ট্রাম্প-শাসিত আমেরিকা”-র জন্য একটা সমাপ্তি বানাতে হয়, সেটা কেমন হতো? 
llঅভিশংসন– ওটাই আমার দৃষ্টিতে ভালো সমাপ্তি। আমি তাকে অবসর নিতে দেখতেই চাইব, এভাবেই বলি। খারাপ সমাপ্তি হবে যদি সে তৃতীয় মেয়াদ পেয়ে যায় এবং পুরো নিয়ন্ত্রণটা নিয়ে নেয়। যে কোনোভাবেই এটা একটা হরর গল্প। ট্রাম্প নিজেই তো এক হরর গল্প, তাই না?
lআমি যখন প্রথম ‘স্ট্রেঞ্জার থিংস’ দেখি, সেটা অনেকটা স্টিফেন কিংয়ের উপন্যাসের মতো লেগেছিল। আপনি কি একমত? 
llআমি এটাকে ততটা স্টিফেন কিং-সুলভ দেখি না, যতটা অন্যরা দেখে। মনে হয় ডাফার ব্রাদার্স আমাকে আমার চেয়ে বেশি কৃতিত্ব দেয়। অনেক মেধাবী মানুষের মতো ওরা আমার লেখা পড়ে বড় হয়েছে। ছোটবেলায়, যখন ওরা বেশি প্রভাবগ্রহণশীল ছিল, তখন স্টিফেন কিং অনেক পড়েছে এবং ভেবেছে: “আমরা এমন কিছু করতে চাই।” কিন্তু তারা খুবই প্রতিভাবান, এবং ওরা যে গল্প বানিয়েছে, তাতে শুধু স্টিফেন কিং-ই নেই– বেশ ভালো পরিমাণে ডাফার ব্রাদার্সও আছে। ভালোই হয়েছে। আমি সব পর্বই দেখেছি। খুবই পছন্দ করি।
lযদি আপনার জীবনের ওপর কোনো সিনেমা বানানো হয়, আপনাকে কে অভিনয় করবে? 
llআমি চাইব কোনো ভালো-দেখতে নায়ক আমাকে অভিনয় করুক, কিন্তু ব্র্যাড পিট এটা করবে বলে মনে হয় না। সে আমার চেয়ে অনেক বেশি সুদর্শন। আমি এখন একটু বয়স্ক হয়ে গেছি, তাই হয়তো ক্রিস্টোফার লয়েড। অথবা ‘টুইন পিকস’-এর যে লম্বা লোকটা আছে, তার নাম কী? কাইল ম্যাকল্যাকলান।
lযখন আরও একটি নতুন চলচ্চিত্র বা টিভি রূপান্তরের প্রস্তাব আপনার টেবিলে আসে, সেটা কি উত্তেজনা আনে নাকি হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয়? –এলপি৪৩টিটি
llআমি এখনও উত্তেজিত হই, যখন আমার কোনো কাজ থেকে চলচ্চিত্র বানানো হয়। এই বছর আগেই ‘দ্য মাংকি’ দেখে ভালো লেগেছে, আর ‘দ্য লাইফ অব চাক’-ও। আমি খুবই আগ্রহী– অপেক্ষা করছি এডগার রাইটের ‘দ্য রানিং ম্যান’-এর রিমেক দেখার জন্য, যা ইংল্যান্ডে শুট হয়েছে। আমি সিনেমার কথা ভেবে লিখি না। শুধু এমন গল্প লিখি যেটা আমার এবং পাঠকদের ভালো লাগবে। তারপর যা হওয়ার, তা-ই হয়। ঠিক আছে। আমি সিনেমা পছন্দ করি, কিন্তু মনে করি বই আর সিনেমা আলাদা জিনিস– যেন আপেল আর কমলা।
lযদি আপনাকে তিনটার মধ্যে থেকে একটি বেছে নিতে হয়–
• ‘দ্য জন্ট’-এর মতো যখন-তখন টেলিপোর্ট করতে পারা;
• ১১/২২/৬৩-এর মতো এমন এক ভাঁড়ারঘরে যেখানে ঢুকে অতীতে একটি নির্দিষ্ট দিনে ফিরে যাওয়া যায়;
• অথবা ‘নিডফুল থিংস’-এর মতো এমন দোকান যেখানে আপনার সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি কিনতে পারবেন–
তাহলে আপনি কোনটা নেবেন? 
llআমি সময় ভ্রমণের কিছুই চাইব না– কারণ তাহলে নিশ্চয়ই গোলমাল হবে। টেলিপোর্ট করার চেষ্টা করলে ভয় হয় আমার পরমাণুগুলো কোনো মাছির সঙ্গে গুলিয়ে যাবে, আর সেই সিনেমাটা আমি দেখেছি (?)– আমি সেটা চাই না। আমার সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা কী? আরে, আমি তো যা চাই সবই পেয়েছি। আমার আলমারিতে দুই জোড়া পরিষ্কার জিন্স আছে। আর আমি– একটু জুতোর মানুষ। জুতো ভীষণ ভালোবাসি। মহিলাদের আমি প্রশংসা করি, কারণ ওদের কাছে নানারকম দারুণ জুতো থাকে। আমার নিজেরই হয়তো ২০ জোড়া জুতো আছে, ভাই। স্নিকার্স, ছোট বুট– সবই। অনেকেই এটা দেখে বলবে: “এ তো পাগলামি ভাই।” আমি বাজি ধরে বলতে পারি, এই লেখা পড়বে এমন অনেক মহিলাই বলবেন, “আমার কিন্তু ৫০ জোড়া আছে।”
lআপনি নাকি ফেব্রুয়ারি, ১৩ সংখ্যা এবং সাক্ষাৎকার দিতে অপছন্দ করেন। এটা কি এখনও সত্যি? 
llএকসময়– যখন আমি তরুণ আর সংগ্রামী লেখক– ভাবতাম, সাক্ষাৎকারে কি বুদ্ধিদীপ্ত, মজাদার উত্তর দেব। এখন যখন বাস্তবে তোমার মতো সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীকে দেখি, তখন নিজেকে আটকে যেতে দেখি। নিজের মুখে শুধু শুনি: “উম … আআ … ইয়ে …” এসব। ব্যাপারটা হলো: কী চাইছ তা ভেবে সাবধানে চাইতে হয়–কারণ তুমি সেটা পেয়ে যেতে পারো। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *