আলোর যুবরাজ

এক ছিলো ছোট্ট ছেলে– নাম তার রাফি। গল্পের বই পড়তে ভালোবাসতো, কিন্তু পড়ার চেয়ে বেশি ভালোবাসতো আঁকতে আর লিখতে। গল্পের বই পড়ে পড়ে সে নিজের মনে গল্প বানাতো, কখনো লিখে রাখতো, কখনো সেই গল্প ঘুড়ি বানিয়ে উড়িয়ে দিতো আকাশে।

একদিন টিফিন পিরিয়ডে হঠাৎ করেই হেডস্যার ক্লাসে এসে ঘোষনা দিলেন– জেলা শিক্ষা অফিসের উদ্যোগে স্কুলে আগামিকাল হবে গল্প লেখার “ডিজিটাল প্রতিযোগিতা!” যে সবচেয়ে সুন্দর গল্প লিখতে পারবে, সে হবে ‘আলোর যুবরাজ’!”

ছাত্রছাত্রীরা উৎসাহে মেতে উঠল। কিন্তু রাফি চুপচাপ। সে ভাবলো, “আগে তো কাগজ কলমে লিখতাম, এখন তো সবাই মোবাইল আর কম্পিউটারে টাইপ করে! আমি কি পারব?”

রাতে জানালার পাশে বসে ছিল রাফি। হঠাৎ জানালা দিয়ে হাওয়া এসে বইয়ের পাতাগুলো উল্টে গেল। আলো ঝলমলে এক ছোট্ট পরি বেরিয়ে এল। তার হাতে ছিল একটা চকচকে কম্পিউটার মাউস।

পরি বলল, “আমি কম্পু–পরি, কল্পনার জগৎ থেকে এসেছি! দেখো, এখন আর কাগজ কলমে কেউ লেখে না, লেখে ডিজিটাল স্ক্রিনে বোতাম টিপে টিপে ! কিন্তু গল্পের জাদু আগের মতোই আছে।”

রাফি অবাক!

“তুমি কি আমাকে লেখায় সাহায্য করতে পারো?”

পরি হেসে বলল,

“তুমি শুধু মন খুলে ভাবো। বাকিটা আমি করে দেব!”

বলতে বলতেই রুমটা এক ঝলক আলোয় ভরে গেল। কম্পিউটার স্ক্রিনে একের পর এক ছবি ফুটে উঠতে লাগল– কখনো মঙ্গলের লাল মাঠ, কখনো পাতালপুরের জলের শহর, কখনো ডালিমকুমারের প্রাসাদ, আবার কখনো কঙ্কাবতীর জাদুর বনে হারিয়ে যাওয়ার দৃশ্য।

রাফি বলল,

“ওগুলো কী পরি?”

“এগুলো তোমার ভাবনার ছবি। তুমি যা কিছু ভাবছো আমি সেটাই বানিয়ে দিচ্ছি।”

রাফি একের পর এক গল্প বলতে লাগল। “ডালিমকুমার হারিয়েছে জাদুর গোলাপ, কঙ্কাবতী খুঁজছে সত্যিকারের ভালোবাসা, আর তাদের সাহায্য করছে এক রোবট পাখি!”

কম্পু–পরি মাউস টিপে ক্লিক ক্লিক করে রঙ তুলল, শব্দের পর শব্দ সাজালো। গল্প আর ছবিতে ভরে উঠলো কম্পিউটার স্ক্রিন। রাতভর চলল সেই সৃষ্টির আনন্দ।

ভোরে পরি বলল,

“রাফি, মনে রেখো– কলম হোক বা বোতাম, কল্পনা আর সৃজনশীলতাই হলো আসল শক্তি। তোমার ভেতরের ভাবনাগুলো তুমি ফুটিয়ে তোল। যে মন দিয়ে কাজ করে, সে–ই হয় আলোর যুবরাজ।”

পরি হাওয়ার মতো মিলিয়ে গেল।

পরদিন স্কুলে প্রতিযোগিতা। সবাই জমজমাট হয়ে বসেছে। কেউ গল্প টাইপ করেছে, কেউ ভিডিও বানিয়েছে, কেউ ছবি এঁকেছে। রবি লাজুকভাবে নিজের গল্পটা খুলল– “ডালিমকুমার আর কম্পু–পরির গল্প।”

গল্পে ছিল বন্ধুত্ব, কল্পনা, ভালোবাসা আর নিজের প্রতি বিশ্বাসের বার্তা। শিক্ষকরা অবাক হয়ে বললেন,

“রাফি, তোমার গল্পে জ্বলে উঠার জাদু আছে!”

সবাই হাততালি দিল। রাফির মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সে বুঝতে পারল, পরি ঠিকই বলেছিল– লেখার আসল শক্তি হৃদয়ে, বোতাম বা আঙুলে নয়।

বাড়ি ফিরে সে জানালার পাশে গিয়ে বসল। চারদিকে চোখ বুলিয়ে পরিকে খুঁজলো। না কোথাও নেই। মনে মনে বলল

“ধন্যবাদ কম্পু–পরি! তুমি না থাকলে আমি সাহসই পেতাম না।”

দূরে কোথাও নরম আলো ঝলমল করে উঠলো, যেন কেউ হাসছে।

তারপর থেকে রাফি আর ভয় পেত না। সে গল্প লিখতো, কম্পিউটারে নিজের কল্পনার জগৎ তৈরি করত। কখনো লিখতো রোবট বন্ধুর গল্প, কখনো উড়ন্ত শহরের স্বপ্ন, কখনো নতুন কোনো মুজিব, রবি বা মাওসেতুং–এর মতো অনুপ্রেরণার কাহিনি। তার প্রতিটি গল্পে একটা বার্তা থাকত–

“যে মনকে সজাগ রাখে, সে–ই পারে পৃথিবী বদলাতে।”

বছর কয়েক পর রাফি বড় হলো। তার লেখা গল্প দেশ–বিদেশে ছড়িয়ে পড়ল। মানুষ বলতে লাগলো–

“এই তো সেই আলোর যুবরাজ, যে কলম আর বোতাম দুটোই ভালোবাসে!”

রাফি তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে হাসত। সে জানে কম্পু–পরি তার ভেতরের সত্বাকে জাগিয়ে দিয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *