আদিবাসী বিভিন্ন ব্র্যান্ডের উদ্যোক্তা নিজেদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ফ্যাশনসচেতন বাঙালি এবং বিশ্বদরবারে ছড়িয়ে দিতে কাজ করে যাচ্ছেন। পোশাকে করছেন ফিউশন। ঐতিহ্যবাহী পিনন, কোমর তাঁতে বোনা ফেব্রিক দিয়ে তৈরি করছেন টপস, কাফতান, সালোয়ার-কামিজ, শাড়ি, কুর্তি, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, ব্লেজারসহ নানান কিছু; যেখানে থাকছে আদিবাসী মোটিফ, জ্যামিতিক প্যাটার্ন, প্রকৃতি ও পাহাড়ি সংস্কৃতির ছোঁয়া।
চোখ বন্ধ করে একবার ভাবুন তো পাহাড়ি পাথুরে পথে হেঁটে যাচ্ছেন কোনো পাহাড়ি তরুণী। সামনে ভেসে উঠবে এক অসাধারণ প্রতিচ্ছবি। হয়তো তাঁর পরনে থাকবে থামি কিংবা পিনোন-হাদি। কাঁধে ঝোলানো থাকবে বাঁশের ঝুড়ি। আদিবাসী পোশাক মানেই অন্যরকম। তাদের সংস্কৃতি, ভাষা, পোশাক, জীবনযাপন সবকিছুর আলাদা কদর রয়েছে। সমতলের বাঙালি হৃদয়েও জায়গা করে নিয়েছে তাদের পোশাক। ঐতিহ্যবাহী এসব পোশাক বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গেছে। অনেক বাঙালি পাহাড়ে বেড়াতে গেলে তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক কেনেন। ঢাকার রাস্তায়ও অনেককে পাহাড়ি ফেব্রিকের পোশাক পরা অবস্থায় দেখা যায়। আদিবাসী বিভিন্ন ব্র্যান্ডের উদ্যোক্তা নিজেদের পোশাক পাহাড় ও সমতলের ফ্যাশনসচেতন মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে কাজ করে যাচ্ছেন। পোশাকে করছেন ফিউশন। ঐতিহ্যবাহী ফেব্রিক দিয়ে তৈরি করছেন টপস, কাফতান, সালোয়ার-কামিজ, শাড়ি, কুর্তি, পাঞ্জাবি, ব্লেজারসহ নানা কিছু।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী পোশাক নিয়ে কাজ করে রাঙামাটির ফ্যাশন ব্র্যান্ড ‘দ্য ফেইরি টেল’। পিনন-হাদি, রীনাই-রিসা, থামি ইত্যাদির পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী পোশাকের অনুপ্রেরণায় তৈরি আধুনিক ফিউশন পোশাক যেমন পিনন স্কার্ট, ড্রেপড পিনন সেট, গাউন ইত্যাদি পাওয়া যায়। আধুনিক থিম নিয়ে দেশীয় পোশাক যেমন–শাড়ি, কামিজ, কুর্তি, পাঞ্জাবি, ফতুয়া ইত্যাদিও পাওয়া যায় ‘দ্য ফেইরি টেল’-এ। ফ্যাশন ব্র্যান্ডটিতে রয়েছে বিয়ের পোশাকও। নারীর ট্র্যাডিশনাল ব্রাইডাল সেট, এথনিক টাচ গাউন, শাড়ি, লেহেঙ্গা এবং পুরুষের ট্রাইবাল কুর্তা, জ্যাকেট সেট, পাঞ্জাবি, ওয়েস্ট কোট, ধুতি–এসব ব্রাইডাল ও সেরেমনিয়াল পোশাক পাওয়া যায়।
‘দ্য ফেইরি টেল’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর মিশি চাকমা বলেন, ‘আমার উদ্যোগের মূল প্রেরণা নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ফ্যাশনের মাধ্যমে বিশ্বমঞ্চে উপস্থাপন করা এবং আদিবাসী নারীর শিল্প, পরিশ্রম ও নান্দনিকতাকে সম্মানজনকভাবে তুলে ধরা। প্রায় ১২ বছর ধরে এ কাজটি করে যাচ্ছি। পোশাক তৈরিতে আমরা সবসময় আরামদায়ক ও মানসম্পন্ন ফেব্রিক ব্যবহারে বিশ্বাসী।’
ঐতিহ্যবাহী পোশাকের পাশাপাশি বিভিন্ন ফিউশনধর্মী পোশাক নিয়ে কাজ করে রাঙামাটির আরেক ফ্যাশন ব্র্যান্ড মিজেল হজাল। ব্র্যান্ডটিতে পিনোন-হাদি, থামি, শাড়ির পাশাপাশি পাওয়া যায় কুর্তি, সালোয়ার-কামিজ, থ্রিপিস, টুপিস, সিঙ্গেল কামিজ, কাফতান, টপস, ফতুয়া, ম্যাক্সি, শার্ট, পাঞ্জাবি ইত্যাদি। নিজস্ব ফেব্রিকে বোনা প্রায় প্রতিটি পোশাকে থাকে ঐতিহ্যবাহী নকশা ও থিম। বাঙালি ও আদিবাসী–সবার পছন্দ মাথায় রেখে পোশাকে নতুনত্ব আনেন ব্র্যান্ডটির স্বত্বাধিকারী তরী চাকমা।
তরী চাকমা বলেন, ‘আমাদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরা এবং নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য পোশাকের নকশায় বেশি প্রাধান্য দিই। কালো ও লাল আমাদের ঐতিহ্যবাহী রং। এখন যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পোশাকে বিভিন্ন রঙের সংমিশ্রণ নিয়ে নিরীক্ষা করা হয়। বিভিন্ন পোশাকে ফ্লাওয়ার প্যাটার্নের লেস যুক্ত করি বৈচিত্র্য আনার জন্য। এগুলো প্রতিদিন পরা যায়, আবার ফিউশন যোগ হয়। সেই সঙ্গে এগুলো ট্র্যাডিশনাল পার্টের অংশ।’
ফেব্রিক
‘দ্য ফেইরি টেল’-এর পোশাকে ব্যবহৃত হয়–কটন, সিল্ক, লিনেন, ক্যাশমিলন, মসলিন, নেট ও হ্যান্ডওভেন ফেব্রিক। সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত এবং মূল উপকরণ হচ্ছে স্থানীয় নারী বুননকর্মীদের কোমর তাঁতে বোনা রেয়ন সিল্কের হ্যান্ডলুম। মিশি বলেন, ‘আমরা সবসময় চেষ্টা করি আমাদের পোশাকের সঙ্গে যেন আদিবাসী ঐতিহ্যের ছোঁয়া বজায় থাকে।’ মিজেল হজালের পোশাক তৈরিতে কটন, লিনেন, হ্যান্ডওভেন ফেব্রিকের পাশাপাশি কোমর তাঁতে বোনা বিভিন্ন ফেব্রিক ও লেইস ব্যবহৃত হয়। পোশাকের ভ্যালু বাড়াতে বাটিক, এমব্রয়ডারি, জারদৌসি কাজও করা হয়।
পোশাকের নকশা, প্যাটার্ন ও থিম
আমাদের প্রতিটি নকশা মূলত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গল্প বলে। প্যাটার্নে দেখা যায়, আদিবাসী মোটিফ, জ্যামিতিক প্যাটার্ন, প্রকৃতি ও পাহাড়ি সংস্কৃতির রঙিন ছোঁয়া। নকশার থিম সাধারণত ‘মডার্ন রুটস’ ধারণা থেকে অনুপ্রাণিত– যেখানে শিকড়ের ঐতিহ্য আধুনিক রুচির সঙ্গে মিশে যায়। আমাদের বিয়ের পোশাকের থিম সাধারণত ‘এথনিক রয়ালটি’, যেখানে ঐতিহ্যবাহী মোটিফ, কারচুপি-জারদৌসি ও হ্যান্ড এমব্রয়ডারির সঙ্গে থাকে সমসাময়িক সিলুয়েট ও লাক্সারি ফিনিশ–বলেন মিশি চাকমা।
বাঙালি ও ওয়েস্টার্ন ফিউশন
আদিবাসী পোশাকে বাঙালি ও ওয়েস্টার্ন ফিউশন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মিশি চাকমা বলেন, ‘দ্য ফেইরি টেল বিশ্বাস করে যে ঐতিহ্য মানে কেবল অতীতে থাকা নয়, বরং সেটিকে সময়ের সঙ্গে এগিয়ে নেওয়া। আমরা আদিবাসী পোশাকের রং, নকশা ও বুনন বজায় রেখে দেশীয় ও ওয়েস্টার্ন স্টাইলের ফিউশন তৈরি করি। যেমন–পিনন দিয়ে তৈরি গাউন-লেহেঙ্গা, ট্রাইবাল মোটিফ ব্লেজার, পাঞ্জাবি ইত্যাদি তৈরি করি। এভাবে ঐতিহ্য ধরে রেখেও আধুনিক ফ্যাশনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন রূপে উপস্থাপন করা হয়।’
পিনন, টাঙ্গাইল, মণিপুরি কাপড় ও কোমর তাঁতের ফেব্রিকের ওপর ভিত্তি করে ডিজাইনার তেনজিং চাকমা কামিজ, টপস, কুর্তি, ফ্রক, জ্যাকেট, ক্রপটপ তৈরি করেন। সেসব পোশাকে থাকে নানা নিরীক্ষা। কালো, সাদা, লাল, হলুদ, মাস্টার্ড ইয়েলো, নীল, ম্যাজেন্টা, কলাপাতা, টিয়া, ল্যাভেন্ডার, সবুজসহ বিভিন্ন রঙের পোশাকের সংগ্রহ থাকে তাঁর ব্র্যান্ড সজপদরে।
দরদাম
ব্র্যান্ডভেদে আদিবাসী পোশাকের দাম ভিন্ন। মিজেল হজালের হ্যান্ডলুমের পোশাকের দাম ৬০০ থেকে আড়াই হাজার টাকা। এগুলো তাঁতিরা তৈরি করেন। একসঙ্গে অনেক কাপড় তৈরি করা যায় বলে দাম তুলনামূলক কম। তবে ব্যাকস্ট্র্যাপ লুমে যে পোশাকগুলো বোনা হয়, সেগুলোর দাম বেশি হয়। এগুলো তৈরিতে অনেক সময় লাগে। অনেক ধাপ পাড়ি দিতে হয়। ফ্লাওয়ার প্যাটার্ন, নকশা ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে দাম নির্ধারিত হয়। দাম সাধারণত পাঁচ হাজার থেকে ২৫-৩০ হাজারও হয়ে থাকে। ‘দ্য ফেইরি টেল’ থেকে কুর্তি তিন হাজার, কামিজ ছয় হাজার, পাঞ্জাবি-ফতুয়া দুই হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার ৫০০, ব্লেজার ১০ হাজারের বেশি দামে কেনা যাবে। ব্রাইডাল সেটের দাম পাঁচ হাজার থেকে শুরু হয়ে ৮০ হাজার হয়ে থাকে। ট্র্যাডিশনাল পোশাকের দাম (পিনন-হাদির) ১০ হাজার ৫০০ থেকে শুরু হয়।