ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার কাদিরদী থেকে সাতৈর বাজারের দূরত্ব সাত কিলোমিটার। সাতৈর বাজার থেকে শেখর ইউনিয়নের বড়গাঁ নতুন বাজারের দূরত্ব ১৪ কিলোমিটার। নতুন বাজার থেকে সহস্রাইল বাজারের দূরত্ব তিন কিলোমিটার। এই অল্প দূরত্বের মধ্যে আঞ্চলিক মহাসড়কের ওপর সপ্তাহে তিন দিন বসে চারটি হাট। ফলে অসহনীয় যানজটের ভোগান্তি এ সড়কে চলাচলকারীদের নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘদিনের এ সমস্যা নিরসনে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।
সহস্রাইল বাজার বোয়ালমারী উপজেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। মাইজকান্দি-ভাটিয়াপাড়া আঞ্চলিক মহাসড়ক বোয়ালমারী থেকে সহস্রাইল হয়ে চলে গেছে গোপালগঞ্জ, যশোর, খুলনা এবং পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা। আলফাডাঙ্গা উপজেলা থেকে যাতায়াতের মূল সড়কটি সহস্রাইল গিয়ে মিশেছে আঞ্চলিক মহাসড়কের সঙ্গে। সহস্রাইল বাজার থেকে আরেকটি সড়ক চলে গেছে রূপাপাত ইউনিয়ন হয়ে নগরকান্দা ও মুকসুদপুর। কেউ কেউ এ সহস্রাইল বাজারকে বোয়ালমারীর হৃদপিণ্ড বলে থাকেন। কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মাগুরা, মহম্মদপুরের যেসব যানবাহন পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা যায়, তাদের সহস্রাইল বাজার হয়ে যেতে হয়।
সহস্রাইল বাজারে সাপ্তাহিক হাটের কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকা পড়ে থাকতে হয় যানবাহন ও যাত্রীদের। প্রতি শুক্রবার ও মঙ্গলবার সহস্রাইল বাজারে সাপ্তাহিক হাট বসে। হাটের দিন ভোর থেকেই সড়কের দুইপাশে তরিতরকারি, ফলমূলসহ নানা ধরনের পণ্য নিয়ে এক থেকে দেড় হাজার দোকান বসে। সড়কের ওপর সারিবদ্ধভাবে পাট, পেঁয়াজ, চৈতালী নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ভ্যান নসিমন। বাজারে আছে লোকাল বাসের দুটি কাউন্টার। আছে দূরপাল্লার বাসের কাউন্টার। এসব কারণে হাটের দিনে সকাল থেকেই সহস্রাইল বাজারে যানজট লেগে থাকে। কখনও কখনও ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানবাহনকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। যানজটে নাকাল হয় যাত্রী, সাধারণ মানুষ। দুর্ঘটনাও ঘটে অহরহ।
২০০৭ সালে ওযান-ইলেভেনের সময় সেনাবাহিনী অবৈধ দোকানপাট ভেঙে দিয়ে সড়কের দক্ষিণ পাশে জায়গা খালি করে দিয়েছিল। সেসব খালি জায়গা ধীরে ধীরে অস্থায়ী দোকানপাটে দখল হয়ে গেছে।
একইভাবে শেখর ইউনিয়নের বড়গাঁ নতুন বাজারে সপ্তাহে দু’দিন সোমবার ও বৃহস্পতিবার মাইজকান্দি-ভাটিয়াপাড়া আঞ্চলিক মহাসড়কের ওপর হাট বসে। এ হাটে প্রচুর পাট আর পেঁয়াজ ওঠে। পাট ও পেঁয়াজভর্তি ভ্যান, নসিমন দাঁড় করিয়ে রাখা হয় মহাসড়কের যত্রতত্র। হাটের দিনে এ বাজারেও চরম ভোগান্তিন্তে পড়তে হয় যাত্রী, পথচারী, সাধারণ মানুষ ও যানবাহনের চালকদের।
সাতৈর ইউনিয়নের সাতৈর ও কাদিরদী বাজারের সাপ্তাহিক হাটও মাইজকান্দি-ভাটিয়াপাড়া আঞ্চলিক মহাসড়কের ওপর বসে। এ দুটি হাটও হয় সোমবার ও বৃহস্পতিবার। সাতৈর শাহী মসজিদকে কেন্দ্র করে শুক্রবারও হাট বসে থাকে। সাতৈরের হাটও পাট ও পেঁয়াজের জন্য বিখ্যাত। হাটের দিন এ আঞ্চলিক মহাসড়কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকে যানবাহন।
এই চারটি স্থানে আঞ্চলিক মহাসড়কের ওপর এসব হাট দীর্ঘদিন ধরে বসছে। এতে সড়কে যেমন ক্রেতাদের ভিড়ে পথচারীদের চলাচল কষ্টকর; তেমনি যানবাহনের দীর্ঘ লাইনে অসহনীয় যানজটে হাঁসফাঁস অবস্থা হয় যাত্রীদের। কখনও কখনও জরুরি রোগী পরিবহনের অ্যাম্বুলেন্সকেও দাঁড়িয়ে থাকতে হয় দীর্ঘ সময় ধরে। হাটের দিনগুলোতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। তীব্র যানজটে স্থবির হয়ে পড়ে স্বাভাবিক কাজকর্ম। হাটের যানজটের কারণে ঢাকা, ফরিদপুর থেকে মাগুরার মহম্মদপুর, বোয়ালমারী, আলফাডাঙ্গা ও গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী, ভাটিয়াপাড়াগামী বা পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকাগামী যাত্রীদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
কাশিয়ানী উপজেলার নড়াইল এম এ মান্নান উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক বোয়ালমারী উপজেলার বাসিন্দা মো. ইউসুফ বলেন, প্রতি সপ্তাহে সোমবার, মঙ্গলবার ও বৃহস্পতিবার বড়গাঁ ও সহস্রাইল সাপ্তাহিক হাটের কারণে স্কুলে পৌঁছতে বিলম্ব হয়। এ তিন দিন খুব সকাল সকাল বাড়ি থেকে রওনা হই। তারপরও কখনও কখনও জ্যামে পড়ে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যায়। তিনি পাট ও পেঁয়াজের হাট সড়কের ওপর থেকে সরিয়ে নেওয়ার দাবি জানান।
অ্যাম্বুলেন্স চালক আরমান মোল্যা বলেন, জরুরি রোগী নিয়ে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা যেতে বড়গাঁ ও সহস্রাইল হাটে আটকা পড়তে হয়। আবার ফরিদপুর হয়ে যেতে চাইলেও সাতৈর আর কাদিরদী হাটের জ্যামে পড়তে হয়।
পাট ব্যবসায়ী লিটন শিকদার বলেন, সহস্রাইল আর বড়গাঁ হাটে প্রতিনিয়তই যানজট থাকে। তবে মাঝেমধ্যে যানজট ভয়াবহ রূপ নেয়। তখন আমাদেরও কষ্ট হয়। পাট কেনা-বেচায় অনেক সময় লেগে যায়। অনেক যাত্রী বাস, ইজিবাইক ছেড়ে দিয়ে হেঁটে বাজার পার হয়ে অন্য যানবাহনে চলে যায়।
তবে যানজটের জন্য অটোভ্যান, নসিমনকে দায়ী করছেন সহস্রাইল বাজার বণিক সমিতির সভাপতি চুন্নু বিশ্বাস। তিনি বলেন, সহস্রাইল বাজারে চারদিক থেকে যানবাহন ঢোকে। সেখানে মোড়গুলোতে অটোভ্যান বসে থাকে, ইচ্ছেমতো ভ্যান ঢুকিয়ে দেয়। তখনই জট সৃষ্টি হয়। আর একবার জট বাঁধলে তা ছাড়াতে দীর্ঘ সময় লাগে। হাটের দিন এক হাজারের ওপরে অস্থায়ী দোকান বসে। বণিক সমিতির পক্ষ থেকে কাঁচাবাজারের জন্য এর আগে নির্দিষ্ট একটা জায়গা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ভেতরে যারা বসেন তাদের বেচাকেনা কম হয়– এ অজুহাতে দোকানদাররা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে আবার সড়কের ওপর তাদের পণ্য নিয়ে বসে পড়েন।
শৃঙ্খলা ফেরাতে বাজার বণিক সমিতির মিটিং ডাকার কথা বললেন বড়গাঁ বাজার বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান মঞ্জু।
এ চারটি হাটে তীব্র যানজটের বিষয়ে অবগত আছেন জানিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তানভীর হাসান চৌধুরী বলেন, এ বিষয়ে স্থানীয় চেয়ারম্যানদের সঙ্গে কথা বলেছি। যাতে সড়কে যানজট না হয় এ জন্য গ্রাম পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়োজিত করার ব্যাপারে চেয়ারম্যানদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এরপরেও যদি কাজ না হয় তাহলে সড়ক ও জনপথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ইউএনও আরও বলেন, মহসড়কের ওপরের অন্য সব বাজারের চেয়ে সহস্রাইল বাজারের হাটই বেশি সমস্যা তৈরি করে। আশপাশে সরকারি জায়গা থাকলে হাট সরিয়ে নেওয়া যেত। মহাসড়কের ওপর হাট আর যানজট সমস্যা নিরসনে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের কথা জানান তিনি।