পাকিস্তানিদের শেষের শুরু

আগের দিনের সুখবরটি ছিল স্বাধীন দেশের স্বীকৃতি পাওয়ার। ৭ ডিসেম্বর ছড়িয়ে পড়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুর্গ হিসেবে পরিচিত যশোর মুক্ত হওয়ার খবর। 

এই খবর নিয়ে পরদিন ৮ ডিসেম্বর আনন্দবাজার পত্রিকা তাদের সম্পাদকীয়র শিরোনাম করে ‘শেষের এই শুরু’। আর প্রথম পাতায় মূল প্রতিবেদনে লেখা হয়, এদিন (৭ ডিসেম্বর) বিকেলে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর সবচেয়ে বড় ঘাঁটি যশোর দুর্গের পতন ঘটেছে। গুরুত্বপূর্ণ সিলেট শহরও শত্রুকবলমুক্ত। ঝিনাইদহ সড়ক ঘাঁটি মুক্তিকামীদের দখলে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকেও পাকিস্তানিরা পালাচ্ছে। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনারা এগিয়ে যাচ্ছেন রাজধানী ঢাকার দিকে।

যশোর মুক্ত হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের উদ্দেশে একটি বার্তা দেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল এস এইচ এফ জে মানেকশ। প্রায় ৭০ হাজার সেনার উদ্দেশে তিনি বলেন, দেরি হওয়ার আগে অস্ত্র সমর্পণ করুন। সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। আপনাদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে (নিউইয়র্ক টাইমস, ৮ ডিসেম্বর)।

জেনারেল মানেকশর ওই বার্তা প্রতি আধা ঘণ্টা পরপর অল ইন্ডিয়া রেডিওতে প্রচারের সিদ্ধান্ত হয়। এতে আরও উল্লেখ ছিল, সমুদ্র কিংবা আকাশপথ; পাকিস্তানি সেনাদের পালানোর সব পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। নতুন করে কোনো রসদ পাওয়ারও সম্ভাবনা নেই। 

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে লেখা হয়, যশোর ছিল ডিভিশন সদরদপ্তর এবং পূর্ব পাকিস্তানের পশ্চিমাংশের সামরিক শক্তির প্রধান ঘাঁটি। একটানা ২৪ ঘণ্টার তীব্র লড়াইয়ের পর অঞ্চলটি দখল করা হয়। পাকিস্তানি সেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে দক্ষিণ দিকে পালাতে শুরু করেছে। 

মুক্ত যশোরে একদিন
শত্রুমুক্ত হওয়ার পর ৮ ডিসেম্বর যশোরে যান নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক সিডনি শনবার্গ।

 এ নিয়ে তিনি তাঁর বই ‘ডেটলাইন বাংলাদেশ: নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান’-এ লিখেছেন, “যশোরের পরিস্থিতি আরও উল্লাসমুখর। কয়েক মাইল দূরের যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে ভারতীয় সাঁজোয়া বহর যখন এগিয়ে চলছে, মানুষভর্তি বাস থেকে চিৎকার ভেসে আসছিল, ‘স্বাধীন বাংলা, শেখ মুজিব’। এটি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দী বাংলাদেশের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য উল্লাসধ্বনি।”

সিডনি শনবার্গ আরও লিখেছেন, মানুষ প্রথমবারের মতো গোটা দিন স্বাধীনভাবে কাটিয়েছেন। অনেক ভবন ও বাড়ির ছাদে পতপত করে উড়ছে বাংলাদেশের লাল, সবুজ ও সোনালি রঙের পতাকা। আনন্দ, হট্টগোলের মধ্যেও একটা বিষণ্নতার সুর লেগে আছে। রাস্তায় যত ভিড়ই হোক; এটি শহরের আদি ৩০ হাজার মানুষের এক-ভগ্নাংশ মাত্র। নিখোঁজদের কেউ আর ফিরবে না। অন্যরা নিহত হয়েছে। মিশনারি ও অন্যান্য নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, পাকিস্তানিরা যশোরের পাঁচ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে।

যশোর শহরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সিডনি শনবার্গ রাস্তার ধারের মাঠে একটি মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেন। বাঁ হাত কাটা, বুকে ছিল দগদগে ক্ষতচিহ্ন। অবস্থান সম্পর্কে তথ্য পাচার করায় এমন দশা করেছিল পাকিস্তানিরা। শনবার্গ লিখেন, পথে কোথাও কোনো তরুণীকে চোখে পড়েনি। কেউ পাকিস্তানিদের যৌন নৃশংসতার শিকার হয়েছে। কেউ শরণার্থী শিবিরে অথবা লুকানো আশ্রয় থেকে এখনও বাইরে আসেনি।

পালানোর সময় পাকিস্তানি সেনারা যশোরের ঝিকরগাছায় কপোতাক্ষ নদের ওপরকার সেতু ভেঙে দেয়। সিডনি শনবার্গের বর্ণনা অনুযায়ী, সেদিন পথের ধারে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল পাকিস্তানিদের বিছানা ও অন্যান্য জিনিসপত্র। এর মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পাঠানো একটি চিঠিও ছিল। যেখানে কোনো এক সৈন্যকে তার ছেলে লিখে, ‘ইন্ডিয়াকে ক্র্যাশ’ করো।

ঢাকা কতদূর 
যশোর পতনের পর পাকিস্তানিদের লক্ষ্য ছিল দুটি। যতদিন পারা যায় ঢাকার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা এবং ঢাকার দিকে যৌথ বাহিনীর অগ্রসর মন্থর করা। আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত সামরিক পর্যবেক্ষণে লেখা হয়, ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে ছোট ছোট সেনাবাহিনীকে সাজিয়ে রেখে এবং পথে বাধা সৃষ্টি করে পাকিস্তানিরা বোঝাতে চেয়েছিল, বাংলাদেশে তারা শেষ পর্যন্ত লড়বে। যশোর পতনের পর তারা মাগুরার পথে ঢাকায় পালায়। এরপর ঢাকার চারপাশে শক্ত ব্যূহ তৈরির চেষ্টা করে।

নিউইয়র্ক টাইমস তাদের প্রতিবেদনে লিখে, পাকিস্তানিরা ঢাকার দিকে যাওয়ার পথে গুরুত্বপূর্ণ সেতুগুলো ধ্বংস করে দেয়। এতে ভারতীয় বাহিনীকে ঢাকার দিকে যেতে হয় অস্থায়ী সেতু বানিয়ে। ৭ ডিসেম্বর তারা ঢাকা থেকে ৪০ মাইল দূরে ছিল। এই পথ পাড়ি দেওয়ার মূল প্রতিবন্ধকতা ছিল প্রশস্ত মেঘনা নদী।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী (অব.) বীরবিক্রম। ‘এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য: স্বাধীনতার প্রথম দশক’ বইয়ে তিনি ৭ ডিসেম্বরের বর্ণনা দিয়েছেন। লিখেছেন, ‘আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া চলে আসি এবং প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করি। ভারতীয় বাহিনী এই সময়টাতে আশুগঞ্জে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। ১১ তারিখ পর্যন্ত আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আশপাশে অবস্থান গ্রহণ করি। পাকিস্তানি বাহিনী তখন ২৭ ব্রিগেডের জাঁদরেল ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাদউল্লাহর নেতৃত্বে আশুগঞ্জ ও ভৈরববাজারে অবস্থান নেয়।’

শেষের শুরু
যশোরে পাকিস্তানিদের পতনের পর আরও কিছু এলাকা শত্রুমুক্ত হয়। সাংবাদিকদের কাছে তখন নতুন নতুন এলাকা মুক্ত হওয়ার খবর আসা নিয়ে আনন্দবাজার লিখে, একটির কথা লিখতে লিখতেই আরেকটিতে পাকিস্তানিদের পতন হওয়ার খবর আসছে। খবর খুব দ্রুত পুরোনো ও বাসি হয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের তখন সম্ভাব্য বিজয়ের দিকে ইঙ্গিত করে গণমাধ্যমটি লেখে, ‘সব তার্কিকদের সংশয় পরাস্ত করিয়া, সব শেখানো বুলি মিথ্যা প্রমাণ করিয়া একটি জাতি ক্রমে ক্রমে প্রতিষ্ঠিত ও জয়ী হইতেছে। তাহার সূচনা যশোহর, তাহার নমুনা শ্রীহট্ট (সিলেট) শহর– সেই বিগিনিং অব দি এন্ড।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *