আলতাফ হোসেন, রাজশাহীর চারঘাটের রায়পুরের বাসিন্দা। দিনমজুরি করে পাঁচজনের সংসারে জুটত না তিন বেলা খাবার। তিন বিঘা জমিতে আমবাগান থাকলেও খরচ তুলতে হিমশিম। এক পাশ দিয়ে আলো প্রবেশের পথ রেখে বাগানের আইলে ৪৮টি খেজুর গাছ লাগান আলতাফ।
গত বছর এগুলো রস সংগ্রহের উপযোগী হয়। এবার ৯২ হাজার টাকায় লিজ দিয়েছেন ৪৫টি খেজুর গাছ। অটোরিকশা কিনে চালাচ্ছেন। আলতাফ জানালেন, সচ্ছলতা ফিরেছে। দুই ছেলে ও এক মেয়ের চাহিদা মেটাতে পারছেন।
আলতাফের মতো আমবাগানের আইলে খেজুর গাছ লাগিয়ে ভাগ্য ফিরেছে চারঘাটের রাওথার বাসিন্দা রফিকুল ইসলামসহ অনেকের। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যে, জেলায় খেজুর গাছ রয়েছে প্রায় ১১ লাখ। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গাছ থেকে রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরি করেন অন্তত ৫০ হাজার মানুষ। গত মৌসুমে প্রায় ১০ হাজার টন গুড় উৎপাদন হয়, যার বাজারমূল্য ছিল প্রায় ২০০ কোটি টাকা। এবার আরও বেশি হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
চাষি রফিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ৩৮ শতাংশ জমিতে আমের বাগান করেছি। তিন আইলে ২০টি খেজুর গাছ বড় করেছি। সার-কীটনাশক ও পরিচর্যা শেষে আম বিক্রি করে পেয়েছি ১২ হাজার টাকা। লোকসান তিন হাজার টাকা। অথচ বিনা খরচে খেজুর গাছ চার মাসের জন্য লিজ দিয়েছি ১৭ হাজার টাকায়। মনের দুঃখে আমবাগান কেটে অন্য ফসলের আবাদ শুরু করেছি।
রফিকুলের কথার সত্যতা পাওয়া গেছে উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্যে। এক বছরে চারঘাট ও বাঘা উপজেলায় আমের বাগান কমেছে প্রায় ২১০ হেক্টর জমির। বিপরীতে বিভিন্ন জমির আইলে বাড়ছে সারি সারি খেজুর গাছ। আমের রাজ্যখ্যাত রাজশাহীতে রাজত্ব করতে চলেছে খেজুর গাছ।
রাজশাহী কৃষি অধিদপ্তরের তথ্য, জেলায় প্রায় ১১ লাখ আট হাজার ১৮টি খেজুর গাছ রয়েছে। নভেম্বরে এসব গাছ থেকে রস সংগ্রহ ও গুড় উৎপাদন শুরু হয়; চলে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। প্রায় ৪৯ হাজার ৭১১ জন রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরিতে জড়িত। গত মৌসুমে জেলায় প্রায় ৯ হাজার ৬৪ টন গুড় উৎপাদন হয়।
নিজের ১৩টির সঙ্গে পুঠিয়ার ঝলমলিয়া গ্রামের গাছি বাহার উদ্দিন লিজ নিয়েছেন ৩৫টি গাছ। তাঁর ভাষ্য, চার মাসের জন্য গাছপ্রতি দিতে হবে ৮০০ টাকা। মৌসুমে একটি গাছে ২০-২৩ কেজি রস মেলে, যা থেকে অন্তত ৯ কেজি গুড় তৈরি করা সম্ভব। গত মৌসুমে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা কেজি দরে গুড় বিক্রি করেছি।
বাহার উদ্দিনের হিসাব ধরলে জেলায় মৌসুমে গুড়ের উৎপাদন দাঁড়ায় ৯ হাজার ৯৭৩ টন। গড়ে ২০০ টাকা কেজি হিসাবে প্রায় ১৯৯ কোটি ৪৬ লাখ টাকার বাজার গড়ে উঠেছে রাজশাহীতে। এবার এটি আরও বাড়বে বলে আশাবাদী চাষি, গাছি ও ব্যবসায়ীরা।
রাজশাহীতে এবার এক হাজার ৬৯৫ কোটি টাকার আম বিক্রি হয়েছে। জেলার প্রধান এ অর্থকরী ফলের পরই পানের বাজার প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার। এখন উঠে আসছে খেজুরের রস ও গুড়। রাজশাহীতে সবচেয়ে বেশি খেজুর গাছ পুঠিয়া, চারঘাট ও বাঘায়– যথাক্রমে পাঁচ লাখ ৭৭ হাজার ১২৫, এক লাখ ৮৪ হাজার ২৭৫ ও এক লাখ ৫৫ হাজার ৯২৫টি। এ ছাড়া বোয়ালিয়ায় ২৪৩, মতিহারে এক হাজার ৫১৮, পবায় ৪০ হাজার ৫০০, তানোরে ১০ হাজার ৭৩২, মোহনপুরে আট হাজার ১০০, বাগমারায় ৩৮ হাজার ৪৭৫, দুর্গাপুরে ৫০ হাজার ৬২৫ ও গোদাগাড়ীতে ৪০ হাজার ৫০০টি।
সরেজমিন পুঠিয়া, চারঘাট ও বাঘার বিস্তীর্ণ এলাকায় গাছিদের খেজুর গাছ পরিষ্কার করে রস সংগ্রহের উপযোগী করতে দেখা যায়। চারঘাটের সরদহ ইউনিয়নের পালপাড়া থেকে রসের হাঁড়ি সংগ্রহ করে তাতে দড়ি বাঁধছেন গাছিদের পরিবারের সদস্যরা। কেউ কেউ মাটি দিয়ে গুড় তৈরির চুলা বানাচ্ছেন। খেজুরের রস ঘিরে কর্মব্যস্ত হয়ে পড়েছে গ্রামগুলো।
পুঠিয়ার দীঘলকান্দি গ্রামের চাষি রুহুল আমিন বলেন, তিন বিঘা জমির আম ও পেয়ারা বিক্রি করে আমি লাভের মুখ দেখিনি। একই জমির তিন আইলে ২০০৬ সালে ৬৩ এবং অন্য দুই ক্ষেতে ৭০টি খেজুর গাছ লাগাই। কোনো খরচ ছাড়াই শীতে প্রতিবছর ১৩৩ গাছের রস থেকে তৈরি গুড় বেচে তিন-চার লাখ টাকা পাচ্ছি। পরিবারের সারাবছরের খাবার নিয়ে আর চিন্তা করতে হয় না।
একই উপজেলার ঝলমলিয়া গ্রামের গাছি বাহার উদ্দিন বলেন, গুড়ের ন্যায্য দাম পেলে ভালো লাভ থাকে। আমরা ভীত অসাধু ব্যবসায়ী নিয়ে। তারা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে রস কিনে তাতে আটা, ভারতীয় চিটা গুড়, ফ্লেভার ও চিনি মিশিয়ে ভেজাল গুড় তৈরি করে কম দামে বাজারে ছাড়েন। তাদের কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হই।
বাঘার হেলালপুরের চাষি আলতাফ হোসেন বলেন, হালকা শীত পড়ছে। খেজুরের রস ঘিরে উৎসবের আমেজ আসছে। এ অঞ্চলের একটি গাছও পরিত্যক্ত থাকে না। আয়-রোজগারের পথ সীমিত থাকায় বহু মানুষ মৌসুমভিত্তিক রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরির কাজ করেন।
চারঘাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল-মামুন হাসান জানান, এবার তারা ভেজাল গুড় প্রস্তুতকারীদের তালিকা করে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবেন।
রাজশাহীর সবচেয়ে বড় খেজুর গুড়ের বাজার পুঠিয়ার বানেশ্বর। এ হাটের খেজুর গুড় ব্যবসায়ী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক খাইরুল ইসলাম বলেন, হাটে আসা চাষি ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে গুড় কিনে পাইকাররা বিভিন্ন প্রান্তে নিয়ে যান। ভেজাল গুড় পেলে পরে তারা আর আগ্রহী হন না। হাটেরও বদনাম। এবার হাট কর্তৃপক্ষ সতর্ক থাকবে।
রাজশাহীর খেজুর গুড়ের অধিকাংশ ক্রেতা অনলাইনের ওপর নির্ভরশীল। এ জন্য সামাজিক মাধ্যমের পেজভিত্তিক বিশাল বাজার গড়ে উঠেছে। ‘দেশি অর্গানিক ফুড’-এর পরিচালক ওবাইদুর রহমান রিগেন বলেন, চারঘাট, বাঘা ও পুঠিয়ায় চাষিদের কাছে গিয়ে আমরা গুড় তৈরি করে বিক্রি করি। তবে হাটের গুড়ে ভেজালের কারণে এখন আমাদেরও বিক্রি করতে ঝক্কি পোহাতে হয়। এর পরও গত মৌসুমের চেয়ে এবার গুড়ের উৎপাদন এবং ব্যবসা বাড়বে বলে আশা করছি।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নাসির উদ্দিন বলেন, দেশজুড়ে রাজশাহীর গুড়ের যে সুনাম, তা রক্ষায় আমরা চাষিদের নিয়ে ভেজাল প্রতিরোধে কাজ শুরু করেছি। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ে চাষিদের সচেতন করছেন।