বাজারে এখন ফাইবার, মেটাল, সুতাসহ নানা উপকরণের ও নানা ধরনের চুড়ি পাওয়া গেলেও কাচের চুড়ির কদর কমেনি একটুও। বছরজুড়েই কাচের চুড়ি ডালা ভর্তি করে পথেঘাটে, প্রসাধনীর দোকানগুলোতে বিক্রি হয়। তবে দেশের বাহারি কাচের চুড়ি বিক্রির একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বেশ সুনাম কুড়াচ্ছে দেশীয় ব্র্যান্ড ‘কাচের চুড়ি’।
২০১৮ সালের মার্চে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে ‘কাচের চুড়ি’ নামে ফেসবুকে একটি পেজ খুলে চুড়ির ব্যবসা শুরু করেন তৌহিদ হাসান। প্রতিষ্ঠানটির এই স্বত্বাধিকারীর ডাকনাম রিয়ান। ব্যবসা শুরুর সময় তিনি ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী।
তৌহিদ জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরু থেকেই স্বাবলম্বী হওয়ার তাগিদ ছিল। তবে পড়াশোনার চাপে দিনভর কম্পিউটারের সামনে বসে থেকে প্রোগ্রামিং করতে করতে কিছুটা অবসাদ চলে আসে। তাই পড়াশোনার পাশাপাশি সহজেই সামলাতে পারবেন, এমন কিছু করতে চাইছিলেন।
পুরান ঢাকার চকবাজারে ঘুরতে গিয়ে রংবেরঙের কাচের চুড়ি চোখে পড়ে তৌহিদের। আর তখনই ভাবেন, এসব চুড়ি অনলাইনে বিক্রি করা গেলে কেমন হয়? এই ভাবনা থেকেই ১ হাজার ৬৫০ টাকা দিয়ে লাল, নীল, হলুদ সবুজ—এই চার রঙের ১২০ ডজন রেশমি চুড়ি কিনে ব্যবসা শুরু করেন।
এত পণ্য থাকতে কাচের চুড়িই কেন বেছে নিলেন জানতে চাইলে তৌহিদ বলেন, ‘কাচের চুড়ি বেশ সহজলভ্য পণ্য। উপহার হিসেবে দিতে চাইলে বেশি পয়সা খরচ না করেও অন্যকে খুশি করা যায়। তাই ছাত্রাবস্থায় অতিরিক্ত খাটনির ঝামেলা এড়াতে কাচের চুড়ি নিয়ে কাজ শুরু করি। উদ্যোগের নামটা বেছে নিতেও বেশি ঝক্কিঝামেলায় যাইনি, বেছে নিয়েছি সহজ নাম কাচের চুড়ি।’
শুরুতে কাচের চুড়ির সম্পূর্ণ কার্যক্রম চালানো হতো অনলাইনে। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে তৌহিদকে একই সঙ্গে পড়াশোনা ও ব্যবসা সামলাতে হয়েছে। করোনাকালে লকডাউনের সময় তাঁর অনলাইন ব্যবসা বেশ ভালোই চলেছিল। ব্যবসায় লাভের মুখ দেখেছেন। ক্রেতার চাহিদা সামাল দিতে তাই করোনাকালের পর ঢাকার খিলগাঁওয়ে কাচের চুড়ির প্রথম অফলাইন দোকান চালু করেন। বর্তমানে অনলাইন কার্যক্রমের পাশাপাশি ঢাকার খিলগাঁও, বনশ্রী ও মিরপুরে কাচের চুড়ির তিনটি শাখা আছে।
৬০টির বেশি নকশার কাচের চুড়ি পাওয়া যায় তৌহিদের এই শাখাগুলোতে। মূলত ঢাকার চকবাজার থেকে চুড়ি সংগ্রহ করেন পাইকারি দামে। তৌহিদ জানান, চুড়ির নকশা ও গড়ন নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারীদের পছন্দের বিষয়টি মাথায় রাখেন। ৪৯ টাকা থেকে শুরু করে চুড়ির ডিজাইন, কারুকার্য ও মানের ভিত্তিতে সাড়ে ৪০০ টাকা দামের প্রতি ডজন চুড়ি মিলবে এই দোকানে। এখানে একই রঙের কাচের চুড়ির অনেক শেডও পাওয়া যায় বলে পোশাকের সঙ্গে সহজে মিলিয়ে চুড়ি খুঁজে পান ক্রেতারা।
বর্তমানে অনলাইন ও অফলাইনে সমানতালে চুড়ির ব্যবসা করছে কাচের চুড়ি। বিশেষ করে ঈদ, ফাল্গুন,পূজা ও পয়লা বৈশাখে ক্রেতার চাহিদা বেড়ে যায় অনেক। তবে মজার ব্যাপার, ক্রেতার প্রায় ৬০ শতাংশ পুরুষ। বর্তমানে তৌহিদের সংগ্রহে থাকা কাচের চুড়ি দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ তো নিচ্ছেনই, সঙ্গে বিদেশেও যাচ্ছে। অনলাইনে চুড়ি বিক্রির প্রধান সমস্যা কাচের চুড়ি যেহেতু ভঙ্গুর, তাই ঠিকভাবে মোড়কজাত করে পাঠাতে বেশ বেগ পেতে হয়। তৌহিদ জানান, উপহারের কাচের চুড়ির জন্য জুতসই মোড়ক বাক্সটি জোগাড় করতে বেশ সময় লেগেছিল তাঁর।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে তৌহিদ এখন পুরোদমে উদ্যোক্তা। কাচের চুড়িতে রেশমি চুড়ি ছাড়াও এখন নানা রকম গয়নাগাটিও পাওয়া যায়। তবে দোকানগুলোর দৃষ্টিনন্দন অন্দরসজ্জা ও দারুণ সব নকশার চুড়িতে চোখ আটকে যায় সবার। আর এখানে চুড়ির দামটাও থাকে হাতের নাগালে।
উৎসব-আয়োজনে পোশাকের সঙ্গে মানানসই কাচের চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ বাঙালিয়ানা অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। উৎসবের আবহের সঙ্গে তাই দেশীয় সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটাতে কাচের চুড়ির জুড়ি মেলা ভার। আর নারীদের এই শখের পণ্যটি নির্বিঘ্নে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে দিতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন তৌহিদ হাসানসহ কাচের চুড়ির সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেক কর্মী।