রাখাইন রাজ্য দখলের কাছাকাছি আরাকান আর্মি, মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের ভূরাজনীতি বদলে যেতে পারে

মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় কৌশলগত অঞ্চল রাখাইন রাজ্য এখন আরাকান আর্মির (এএ) পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে আসার পথে রয়েছে। সামরিক জান্তা সরকার যখন দেশের অন্য অঞ্চলে দখলকৃত ভূমি পুনরুদ্ধারে ব্যস্ত, তখন আরাকান আর্মি ১৭টি অঞ্চলের মধ্যে ১৪টি অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রেখেছে। এই রাজ্যটি বঙ্গোপসাগরের উপকূলে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থিত, যার কৌশলগত গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আরাকান আর্মির অগ্রগতির ফলে মিয়ানমারের চলমান গৃহযুদ্ধ এবং আঞ্চলিক ভূরাজনীতির দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হতে পারে। একের পর এক বিজয়ের পর, তারা এখন রাখাইনের বাকি অঞ্চলগুলো দখলের প্রস্তুতি নিচ্ছে, যার মধ্যে রাজ্যের রাজধানী সিত্তে, কিয়াউকফিউ (যা ভারতের গুরুত্বপূর্ণ বন্দর প্রকল্প এবং জ্বালানি পাইপলাইন সাইট) এবং চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের অংশ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ গভীর সমুদ্রবন্দর রয়েছে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আরাকান আর্মির সামনে এখন রাখাইন রাজ্যের পুরো এলাকা দখলের সুযোগ রয়েছে। তবে, এর মধ্যে একটি বড় মানবিক সংকট তৈরি হচ্ছে। রাখাইনে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনের খবর পাওয়া যাচ্ছে। সামরিক বাহিনী সেখানে প্রবেশ এবং বিভিন্ন সরঞ্জামের পরিবহন বন্ধ করে দেয়ার কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে, এবং জাতিসংঘ জানিয়েছে যে, ২০ লাখের বেশি মানুষ খাদ্য সঙ্কটে রয়েছে।

আরাকান আর্মির অগ্রগতি চলাকালীন, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী আকাশপথে হামলা বাড়িয়ে দিয়েছে, যা ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকে নিয়মিতভাবে ঘটছে। ২০২৩ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে আকাশপথে হামলায় ৪০২ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে, যার মধ্যে ৯৬ জন শিশু রয়েছে।

এছাড়া, আরাকান আর্মি এবং সামরিক বাহিনী দুই পক্ষই বাধ্যতামূলক সেনা নিয়োগ চালু করেছে। আরাকান আর্মি ১৮ থেকে ৪৫ বছরের পুরুষদের এবং ১৮ থেকে ২৫ বছরের নারীদের সেনায় অন্তর্ভুক্ত করছে। এর বিপরীতে, সামরিক বাহিনী ৭০ হাজার নতুন সদস্য নিয়োগ করেছে।

আরাকান আর্মি এখন চীনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিয়াকফিউ বন্দর দখল করার প্রস্তুতি নিচ্ছে, যা চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের অংশ এবং মিয়ানমারকে চীনের ইউনান প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সিত্তে অঞ্চলের দক্ষিণে কিয়াকফিউতে আক্রমণ আসন্ন। তবে, চীনের নিরাপত্তাকর্মীরা ইতোমধ্যেই সেখানে অবস্থান করছেন, এবং বেইজিং জানে যে আরাকান আর্মি বন্দরটি দখল করতে পারে।

ভারতের জন্যও এই অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে, কারণ এটি তাদের দুর্গম উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে যুক্ত করবে। এই করিডোরটি বাংলাদেশকে বাইপাস করে মিয়ানমারের সাথে একটি বিকল্প বাণিজ্য পথ তৈরি করবে। যদি আরাকান আর্মি এই এলাকা দখল করতে সক্ষম হয়, তাহলে তারা চীন এবং ভারতের গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন ও বাণিজ্য পথগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে, যা তাদের প্রভাব অনেকগুণ বাড়িয়ে তুলবে।

ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসি-মিয়ানমারের মতে, আরাকান আর্মি এখন মিয়ানমারের অন্যান্য জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে বৃহত্তর প্রভাব বিস্তার করছে। বর্তমানে, আরাকান আর্মি মিয়ানমারের বৃহত্তম সশস্ত্র গোষ্ঠী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এবং তাদের প্রভাব আগামী বছরগুলিতে আরও ব্যাপক হতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *