পুলিশ বলছে ত্রিভুজ প্রেম, র‌্যাব বলছে ফাঁদে ফেলে হত্যা

ত্রিভুজ প্রেমের কারণে আশরাফুল হককে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। রাজধানীতে ড্রামের ভেতর থেকে খণ্ডিত লাশ উদ্ধারের ঘটনায় জরেজুল ইসলামকে গ্রেপ্তারের পর আজ শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানায় ডিবি। অপরদিকে আশরাফুলের প্রেমিকা শামীমা আক্তার ওরফে কোহিনুরকে গ্রেপ্তারের পর র‌্যাব জানিয়েছে, আশরাফুলকে ফাঁদে ফেলে ১০ লাখ টাকা আদায়ের পরিকল্পনা করেছিলেন জরেজুল ও শামীমা। পরে তাকে হত্যা করা হয়। 

গত ১৩ নভেম্বর জাতীয় ঈদগাহ মাঠের পাশের পড়ে থাকা ড্রাম থেকে ২৬ টুকরো মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে আঙুলের ছাপ মিলিয়ে তার পরিচয় নিশ্চিত করা হয়। এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা করেছে নিহতের পরিবার। জরেজুল ও আশরাফুল বাল্যবন্ধু। দু’জনের বাড়ি রংপুরে। আশরাফুল একজন পেঁয়াজ-রসুন ব্যবসায়ী। 

গতকাল শুক্রবার কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে মূল আসামি জরেজুলকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। এ ঘটনায়  শনিবার রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ডিবি প্রধান শফিকুল ইসলাম বলেন, ত্রিভুজ প্রেমের কারণে আশরাফুলকে বুধবার দক্ষিণ দনিয়ার ভাড়া বাসায় হত্যা করা হয়। লাশ নিয়ে সারারাত ওই বাসায় কাটান জরেজুল ও শামীমা। পরদিন ড্রামে করে খণ্ডিত লাশ হাইকোর্ট সংলগ্ন জাতীয় ঈদগাহ মাঠের পাশে তারা ফেলে যায়।

ডিবি প্রধান জানান, জরেজুল মালয়েশিয়া প্রবাসী। মাস দেড়েক আগে তিনি দেশে আসেন। বিদেশে থাকাকালে জরেজুল একটি অ্যাপের মাধ্যমে কুমিল্লার প্রবাসীর স্ত্রী শামীমা ইসলামের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন। দেশে ফেরার পর জরেজুলের স্ত্রী বিষয়টি জানতে পারলে সংসারে মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়। বন্ধু আশরাফুলকে বিষয়টি সমাধানের জন্য অনুরোধ করেন তিনি। এরপর শামীমার মোবাইল নম্বর আশরাফুলকে দেন জুরেজ। কিন্তু পরবর্তীতে আশরাফুল নিজেই শামীমার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন।

ডিবি জানায়, নিহত আশরাফুল তার বন্ধু জরেজকে ১৪ লাখ টাকা দিয়ে জাপান পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেন। এর মধ্যে শামীমার ৭ লাখ টাকা দেওয়ার কথা ছিলো। মূলত এই টাকার সংস্থান এবং শামীমার সাথে একান্তে দেখা করার আশায় দুই বন্ধু একত্রে রংপুর থেকে গত মঙ্গলবার ঢাকায় আসেন। ঢাকায় তিনজন একত্রে দেখা করার জন্য একটি নিরাপদ স্থান খোঁজ করেন। 

শফিকুল ইসলাম আরও জানান, তিনজনের পরিকল্পনায় তারা ডেমরা থানাধীন ব্যাংক কলোনি এলাকায় একটি বাসা ভাড়া নেন। একইদিন দুপুর আড়াইটার দিকে শামীমা, আশরাফুল ও জরেজুল বাসায় ওঠেন। শামীমার সঙ্গে আশরাফুলের সম্পর্কের কথা ওই বাসায় জেনে যান জরেজুল। এ নিয়ে দুই বন্ধুর মধ্যে তর্কবিতর্ক হয়। জরেজ বাসা থেকে বেরিয়ে যান। পরে ফিরে দেখেন, আশরাফুল ঘুমাচ্ছে। তখন তিনি ঘরে গোপনে অবস্থান নেন। পরে আশরাফুল ঘুম থেকে জেগে বিকৃত যৌনাচারের জন্য শামীমাকে জোর করতে থাকেন। তখন শামীমা প্রলোভন দেখিয়ে দড়ি দিয়ে তার হাত বেঁধে দেন। এরমধ্যে শামীমা চিৎকার করলে জরেজ বেরিয়ে হাতুড়ি দিয়ে আশরাফুলের হাঁটুতে বাড়ি দেন। তিনি চিৎকার করতে থাকলে শামীমা তার মুখে ওড়না পুরে দিয়ে স্কচটেপ পেঁচিয়ে দেন। একপর্যায়ে আশরাফুল মারা যান। 
ডিবি প্রধান বলেন, বুধবার সারারাত তারা লাশের সাথেই একই বাসায় অবস্থান করেন। পরদিন সকালে দু’জনে পরিকল্পনা করেন লাশ গুম করার। বাজার থেকে দুইটি প্লাস্টিকের ড্রাম, পলিথিন ও লাশ কাটার জন্য স্থানীয় দোকান থেকে একটি চাপাতি কিনে আনা হয়। মৃতদেহ বাথরুমে নিয়ে ২৬ টুকরো করা হয়। দুপুরে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে লাশ নিয়ে হাইকোর্ট এলাকায় ফেলে যান তারা।

এদিকে শুক্রবার জরেজুলের প্রেমিকা শামীমাকে কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। এ ঘটনায় আজ শনিবার কারওয়ান বাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। র‌্যাব বলছে, প্রেমিকাকে দিয়ে ফাঁদে ফেলে আশরাফুলের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা আদায়ের পরিকল্পনা করেছিলেন জরেজুল। এই টাকার মধ্যে ৭ লাখ টাকা নেবেন জরেজুল এবং শামীমা নেবেন ৩ লাখ। পরিকল্পনা অনুযায়ী, শামীমা আশরাফুলের সঙ্গে মাসখানেক আগে ফোনে যোগাযোগ শুরু করে তার প্রতি আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেন। গত মঙ্গলবার জরেজুল নিহত আশরাফুলকে নিয়ে ঢাকায় আসেন। পরদিন জরেজুল ও আশরাফুল ও শামীমা শনির আখড়ার নূরপুর এলাকায় বাসা ভাড়া নেন। আশরাফুলকে মালটার শরবতের সঙ্গে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে অচেতন করে ফেলেন। তখন আশরাফুলের হাত দড়ি দিয়ে বেধে ফেলা হয় এবং মুখ কসটেপ দিয়ে আটকে দেওয়া হয়। এরপর জরেজুল অতিরিক্ত ইয়াবা সেবন করে উত্তেজিত হয়ে অচেতন থাকা আশরাফুলকে হাতুড়ি দিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে থাকেন। অতিরিক্ত আঘাত এবং মুখ কসটেপ দিয়ে আটকানো থাকায় শ্বাস না নিতে পেরে আশরাফুল মারা যান।

রংপুর অফিস জানিয়েছে, গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার গোপালপুর নয়াপাড়া আল মাহফুজ মাদ্রাসা মাঠে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে আশরাফুলের দাফন করা হয়।

আশরাফুলের স্ত্রী লাকী বেগম আর্তনাদ করে বলেন, বন্ধু জরেজুলকে আপন ভাই মনে করতেন আশরাফুল। জাপান যাওয়ার জন্য ১০ লাখ টাকা চেয়েছিলেন জরেজুল। তিনি তা দিতেও চেয়েছিলেন। তারপরও জরেজুল তার স্বামীকে বাঁচতে দেননি। জরেজুলের ফাঁসি দাবি করেন তিনি।

নিহতের মা এছরা খাতুন ছেলে হত্যার ঘটনায় দফায় দফায় মূর্ছা যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আমার বেটা (ছেলে) তো কারও ক্ষতি করে নাই। তাহলে কেন এমন করল ওরা? কেন আমার বেটাকে টুকরা টুকরা করল? দুই নাতী-নাতনীসহ এ্যালা কায় হামার সংসারটা দেকপে!’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *