চট্টগ্রাম বন্দরের ট্যারিফ বাড়ানোর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ব্যবসায়ী সংগঠন, শিল্পপতি, চালক ও শ্রমিকদের প্রতিবাদ এবং আল্টিমেটাম পরিস্থিতিতে বন্দর কর্তৃপক্ষ গতকাল শনিবার একটি বক্তব্য প্রদান করেছে। এতে বলা হয়, দীর্ঘ ৪০ বছর পর বাস্তবতার ভিত্তিতে এই সমন্বিত ট্যারিফ নির্ধারণ করা হয়েছে। তা কার্যকর না হলে উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা ব্যাহত হবে।
বন্দর কর্তৃপক্ষ উল্লেখ করেছে, দেশের আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্যের প্রায় ৯২ শতাংশ এবং কন্টেনার পরিবহনের ৯৯ শতাংশ চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। ১৩৮ বছরের যাত্রায় পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে অবকাঠামোগত ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্য বিপুল অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন হয়। অথচ বন্দর পরিচালনার মূল উৎস ট্যারিফ গত চার দশকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো হয়নি। এ সময়ে অন্যান্য আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বন্দরে ট্যারিফ বহুবার বৃদ্ধি পেয়েছে। জাহাজ ভাড়া, সেবা প্রদানকারী সংস্থার মাশুল, জ্বালানি ব্যয়, জনবল ব্যয় এবং যন্ত্রপাতি ক্রয় ও মেরামতের খরচও বেড়েছে বহু গুণে।
বন্দর কর্তৃপক্ষের বক্তব্যে বলা হয়, ১৯৮৫–৮৬ অর্থবছরে যেখানে মাত্র ৩৯ হাজার টিইইউএস কন্টেনার হ্যান্ডলিং হয়েছিল, সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে তা বেড়ে হয়েছে ৩২ লাখ টিইইউএস। বর্ধিত চাপ সামলাতে নতুন টার্মিনাল, ক্রেন, সাপোর্ট ভেসেল ও আধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত করতে হয়েছে। ১৯৮৬ সালে বন্দর বহরে সাপোর্ট ভেসেল ছিল ১৯টি, বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮টিতে। ডিজিটালাইজেশন ও গ্রিন পোর্টে রূপান্তরের প্রস্তুতিতেও খরচ বেড়েছে।
এনসিটি, সিসিটি, পানগাঁও আইসিটি, পিসিটি, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর, বে টার্মিনালসহ অসংখ্য প্রকল্প বাস্তবায়ন ও সম্প্রসারণে বিপুল ব্যয় হচ্ছে। ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে আগামী পাঁচ বছরে পাঁচ মিলিয়ন টিইইউএস পরিচালনার সক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে। ইয়ার্ডের ধারণক্ষমতা ৫৪ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৬২ হাজার করা হয়েছে। ৩৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ হচ্ছে হেভি লিফট জেটি। চলমান ও পরিকল্পিত সব প্রকল্প বাস্তবায়নে এখন প্রয়োজন প্রায় ৩৩ হাজার ৩২১ কোটি টাকা।
বন্দরটি জোয়ার–ভাটা নির্ভর হওয়ায় কর্ণফুলী চ্যানেলের নাব্যতা রক্ষায় সারা বছর সংরক্ষণমূলক ড্রেজিং করতে হয়। আন্তর্জাতিক মানের কী গ্যান্ট্রি ক্রেন, আরটিজি, রেল–মাউন্টেড গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ আধুনিক যন্ত্রপাতি ক্রয়, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় বাড়ছে। ১৯৮৬ সালের তুলনায় মুদ্রাস্ফীতির হার বেড়েছে প্রায় ২৮৪ শতাংশ। বন্দর নিরাপত্তা ও নজরদারিতে আইএসপিএস কোড অনুযায়ী বহির্নোঙর এলাকা ১০ নটিক্যাল মাইল থেকে বাড়িয়ে ৬২ নটিক্যাল মাইল করা হয়েছে। ভিটিএমআইএসসহ আধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত করা হয়েছে এবং নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ৩৫০ জন ওয়াচম্যান। কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বেতন–ভাতা, আবাসন, চিকিৎসা, শিক্ষা ও কল্যাণসেবায় ব্যয়ও ক্রমাগত বাড়ছে।
এতে বলা হয়, বঙ্গোপসাগরের এ অঞ্চলভুক্ত সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও ভারতের বন্দরগুলো নির্দিষ্ট সময় পরপর ট্যারিফ পর্যালোচনা করে বাস্তবতার সাথে মেলাচ্ছে। সেখানে চট্টগ্রাম বন্দর ১৯৮৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তা করেনি। ২০০৭ সালে মাত্র ৫টি সেবার ট্যারিফ সীমিত আকারে সমন্বয় হয়েছিল। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় থাকতে হলে টেকসই ও বাস্তবসম্মত ট্যারিফ অপরিহার্য, অন্যথায় পেছনে পড়ে থাকতে হবে।
বন্দর কর্তৃপক্ষের মতে, ‘ট্যারিফ বৃদ্ধি’ না বলে ‘সমন্বয়’ বলা উচিত। এতে দক্ষতা ও দ্রুততার সাথে সেবা দেওয়া সহজ হবে। বিশ্বের প্রতিটি আন্তর্জাতিক বন্দরের মতো চট্টগ্রাম বন্দরেরও প্রাতিষ্ঠানিক ট্যারিফ নীতি প্রণয়ন জরুরি। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মানের পরামর্শক নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছে, যাতে নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে ট্যারিফ রিভিউ করা যায় এবং ভবিষ্যতে জটিলতা তৈরি না হয়। শুধু আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্যের সুবিধা নয়, বাংলাদেশকে ম্যানুফ্যাকচারিং হাবে রূপান্তরের সরকারি ভিশন বাস্তবায়নে চট্টগ্রাম বন্দরকে বিশ্ব মানে গড়ে তুলতে হবে। অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি ও আর্থিক কাঠামোতে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান থাকলে কর্মসংস্থান, বৈদেশিক আয় ও সরকারি রাজস্বও বৃদ্ধি পাবে। নতুবা বন্দরটি ট্র্যাডিশনাল কাঠামোয় আটকে থেকে বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারানোর ঝুঁকি থাকবে।