ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের শতবর্ষ উদ্‌যাপন

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ক্ষমতায় আসীন করতে যে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বড় ভূমিকা পালন করেছে, সেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) শতবর্ষপূর্তি উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানে অংশ নিলেন হাজারো সদস্য।

পশ্চিম ভারতের নাগপুর শহরে আরএসএস সদর দপ্তরে বৃহস্পতিবার দেওয়া বক্তৃতায় সংগঠনের প্রধান মোহন ভাগবত পাকিস্তানের সঙ্গে চলতি বছরের সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা বিষয়ে আলোকপাত করেন।

তিনি বলেন, “বিশ্ব একে অপরের ওপর নির্ভর করেই চলে। যে কোনো দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক এভাবেই বজায় থাকে। কোনো দেশই একা টিকে থাকতে পারে না।”

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ভারতের ওপর উচ্চ শুল্ক চাপানোর পর মোদী স্বয়ংসম্পূর্ণতার ওপর জোর দেন। সেই অবস্থানের প্রতি সমর্থন প্রকাশ পেয়েছে মোহন ভাগবতের কথায়।

বিবিসি লিখেছে, কেবল পুরুষরাই আরএসএসের সদস্য হতে পারে। ভারতের হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী এ সংগঠনের বিরুদ্ধে ‘বিভেদ সৃষ্টিকারী মতাদর্শ’ চর্চার অভিযোগ রয়েছে, যদিও তা অস্বীকার করে আসছে আরএসএস।

১৯২৫ সালে চিকিৎসক কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার প্রতিষ্ঠিত আরএসএসকে ভারতের এখনকার শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) আদর্শিক ভিত্তি হিসেবে দেখা হয় এবং এটাই বর্তমানে ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী সংগঠন হয়ে উঠেছে।

আরএসএস যদিও নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন বলে না, তবু তার মতাদর্শ এবং বিজেপির সঙ্গে যোগসূত্রের কারণে সংগঠনটি ভারতীয় রাজনীতিতে নির্ধারকের ভূমিকা পালন করে। অনেক আরএসএস স্বয়ংসেবকই বিজেপির সমর্থক।

আরএসএসের প্রধান মোহন ভাগবত। ফাইল ছবি: রয়টার্স

তরুণ বয়সে আরএসএসে প্রচারক হিসেবে যোগ দেওয়া মোদী বুধবার দিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে এ সংগঠনের প্রশংসা করেন। সংগঠনটির শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে বিশেষ স্মারক ডাকটিকেট ও মুদ্রা উন্মোচন করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী, যা নিয়ে সমালোচনামুখর হয়েছে বিরোধীদলগুলো।

আয়োজকদের তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবাv নাগপুরের অনুষ্ঠানে ৩ হাজার ৮০০ স্বয়ংসেবক অংশ নেন।

আরএসএস নারীদের সদস্য হিসেবে গ্রহণ করে না, তবে তাদের জন্য একটি সমান্তরাল সংগঠন আছে। সংগঠনের সদস্য পুরুষরা খাকি প্যান্ট, সাদা হাতা গোটানো শার্ট ও কালো ত্রিকোণ টুপি পরে মাঠে সামরিক কায়দায় দাঁড়ান। প্রখর রোদের নিচে তারা একযোগে শারীরিক কসরত করেন, যা প্রতিদিনের সভার শুরুতে তারা করে থাকেন।

ভাগবত বলেন, মাত্র কয়েকজন পুরুষ নিয়ে শুরু হওয়া সংগঠনটি এখন বিশ্বের বৃহত্তম স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।

আরএসএসে কতজন সদস্য আছে তা জানতে চাইলে মুখপাত্র সুনীল আম্বেকার বলেন, তারা এর হিসাব রাখেন না।

তিনি বলেন, “এটি কোনো সরকারি কাঠামো নয়। দয়া করে বুঝতে চেষ্টা করুন, আপনি যদি আমাদেরকে একটি খুব নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে দেখেন, তাহলে আপনি আরএসএসকে বুঝতে পারবেন না। আরএসএস একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, যারা মাঠে কাজ করে।”

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আরএসএসের সদস্য কে এবং তাদের কতজন সদস্য আছে—এ বিষয়টি অস্পষ্ট রাখা ‘ইচ্ছাকৃত’।

হরিয়ানার অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর তনিকা সরকার বলেন, এটি একটি অত্যন্ত জটিল সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক।

“এটি একটি বিশাল ও বিস্তৃত নেটওয়ার্ক, যাকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা বা বর্ণনা করা কঠিন; কারণ আপনি কখনোই বুঝতে পারবেন না যে আরএসএস কোথায় শেষ হয় এবং অন্যান্য কট্টর ডানপন্থি সংগঠন কোথা থেকে শুরু হয়।”

তার কথায় সংঘ পরিবারের দিকে ইঙ্গিত রয়েছে, যা হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর একটি পরিবার এবং আরএসএসের নেতৃত্বে রয়েছে।

ঠিক কীভাবে আরএসএস গঠিত তা সুনির্দিষ্টভাবে বোঝা সহজ নয়। সংগঠনটি স্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মত বেশ কয়েকটি দাতব্য কর্মসূচি চালায় এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সহায়তা করতে, স্বেচ্ছাসেবক সংগঠিত করতে এবং ত্রাণ বিতরণ করতে স্বয়ংসেবকরা প্রায়ই ঘটনাস্থলে থাকেন।

বিজনেস কনসালটেন্সি ফর্ম এশিয়া গ্রুপের একজন পার্টনার এবং সরকারের একজন সাবেক উপদেষ্টা অশোক মালিক বলেন, “একে একটি রাজনৈতিক সংগঠন বলা যায়, একে একটি এনজিও বলা যায়, একে একটি কল্যাণমূলক সংগঠন বলা যায়, যার সবকটিই সত্য এবং তার কোনোটিই পুরোপুরি ঠিক নয়।”

কিন্তু সংগঠনটির হিন্দুত্ববাদী নীতিগুলোই একে বিতর্কিত সংগঠনে পরিণত করেছে বলে মনে করেন অধ্যাপক তনিকা সরকার।

“মূলত এর গভীর ইসলামবিদ্বেষের জন্য—যে শিক্ষা শত বছর ধরে দিয়ে আসছে সংগঠনটি। তাদের দাবি, কেবল হিন্দুরাই এ দেশের (ভারতের) যথার্থ মালিক এবং নাগরিকত্ব হিন্দুদেরই প্রাপ্য অধিকার।”

এ মতাদর্শই ভারতীয় জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশকে ‘অন্য’ হিসেবে চিহ্নিত করে তোলে বলে মনে করেন অধ্যাপক তনিকা।

আরএসএসের শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে চলতি সপ্তাহে বিশেষ স্মারক ডাকটিকেট ও মুদ্রা উন্মোচন করেন নরেন্দ্র মোদী।

ভারতে জাতিগত বৈচিত্র্যের যে দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, তার উদাহরণ টেনে ভাগবত বৃহস্পতিবারের বক্তৃতায় নিজেকে বিভেদ ও সহিংসতা থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেন। তিনি এমন মনোভাব প্রায়ই প্রকাশ করে থাকেন।

তিনি বলেন, “আমাদের সবার স্বতন্ত্র পরিচয় থাকলেও আমরা সবাই একটি বৃহত্তর সমাজের অংশ। একটি সমাজ, একটি দেশ, একটি সংস্কৃতি এবং একটি জাতি হিসেবে আমরা একত্রিত।”

তবে বিবিসি লিখেছে, ভারতের স্বাধীনতা-পরবর্তী কিছু অন্ধকারাচ্ছন্ন অধ্যায়ের সঙ্গে আরএসএস প্রচারিত মতাদর্শের যোগসূত্র রয়েছে।

যে হিন্দু মবের মাধ্যমে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর উত্তর ভারতের অযোধ্যায় ষোলো শতকের বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়, তাতে আরএসএস সদস্যরাও ছিলেন। তাদের দাবি, একটি মন্দির ধ্বংস করে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল।

ওই ঘটনায় ভারতজুড়ে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা দেখা দেয়, যাতে দুই হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারান। এ ঘটনার পর আরএসএসকে নিষিদ্ধ করা হয়। স্বাধীন ভারতে এর আগেও সংগঠনটি দুইবার নিষিদ্ধ হয়েছিল। প্রথমবার নিষিদ্ধ করা হয় মহাত্মা গান্ধী হত্যাকাণ্ডের পর; হত্যাকারীদের একজন সাবেক আরএসএস সদস্য ছিলেন বলে বিশ্বাস করা হয়।

অযোধ্যায় যেখানে একসময় মসজিদ ছিল, সেখানে মন্দির নির্মাণের দশক পুরনো প্রতিশ্রুতি গত বছর পূরণ করেছেন মোদী।

বিবিসি লিখেছে, সম্প্রতি আরএসএস তাদের জনসংযোগ বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। গত মাসে সংগঠনটি দিল্লিতে তিন দিনের এক সম্মেলনের আয়োজন করে এবং সংবাদমাধ্যমকে আমন্ত্রণ জানায়। যদিও শতবর্ষপূর্তির আয়োজনের দুয়ার কেবল বিদেশি সংবাদমাধ্যমের জন্য খোলা ছিল, তবুও সবকিছু ছিল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত; অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী বা স্বয়ংসেবকদের সঙ্গে সাংবাদিকদের কথা বলার অনুমতি দেওয়া হয়নি।

অশোক মালিক মনে করেন, সংযোগ স্থাপনের এ প্রয়াস আরএসএসকে ভালোভাবে তুলে ধরার প্রচেষ্টার অংশ।

তিনি বলেন, “আমাদের রাজনৈতিক এবং জনপরিসরের বিষাক্ত ভাষা আমাদের সমাজের জন্য দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ। এর সংশোধন ও পরিপক্বতা আনার চেষ্টা করছে আরএসএস।”

কিন্তু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর জন্য এ ‘কোমল চেহারা’ আরএসএসের মতাদর্শে কোনো পরিবর্তন আনে না। সংগঠনটির চোখে ভারত মূলত ‘হিন্দুদেরই দেশ’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *