ওজন বেড়ে যাওয়ার ভয়ে কম খাচ্ছেন? হতে পারে সেটি মানসিক রোগের লক্ষণ

শরীরের অতিরিক্ত ওজন কোনোভাবেই ভালো কিছু নয়। তাই ওজন কমাতে বা নিয়ন্ত্রণে রাখতে অনেকেই ডায়েট মেনে চলেন এবং শরীরচর্চা করে থাকেন। বিষয়টি মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়।তবে অনেকেই আছেন যারা মনে করেন, ওজন কমিয়ে পাতলা গড়নের হতে পারলে তাদের জীবনে আনন্দের শেষ থাকবে না। সেইজন্য তারা ভীষণ কম খাবার খান, কখনো কখনো একদমই না খেয়ে থাকেন এবং পরবর্তীকালে খাওয়াই বন্ধ করে দেন। আবার যখন খান তখন অত্যন্ত অপরাধবোধের সঙ্গে অতি অল্প পরিমাণে খান।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই নিয়ন্ত্রণ নেশার মতো হয়ে দাঁড়ায়। বয়স ও উচ্চতার হিসেবে তাদের ওজন স্বাভাবিকের চেয়েও কমে যায়। তাদের চেহারা ধীরে ভেঙে যেতে থাকে, কিন্তু তারা মনে করেন যে এখন তারা মোটাই আছেন।

মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এই বিষয়টিকে চিহ্নিত করেছেন “অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা” নামক মানসিক রোগ হিসেবে।

তাদের মতে, এটা এক ধরনের ইটিং ডিসঅর্ডার বা ভোজন বিকার যার ফলে রোগীর বিকৃত দেহ, অস্বাভাবিক কম ওজন থাকার পরও তার মধ্যে ওজন বেড়ে যাওয়ার চরম আতঙ্ক লক্ষ্য করা যায়। অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হওয়ার কারণেই সাধারণত এই সমস্যার উৎপত্তি হয়।

অ্যানোরেক্সিয়া কোনো সুস্থ জীবনশৈলী নয়।এটি নিজেকে নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগার ফলে তৈরি এক গুরুতর অসুখ। তবে সুচিকিৎসায় সুন্দর স্বাস্থ্য ফিরে পাওয়া সম্ভব।

অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসার উপসর্গ

অ্যানোরেক্সিয়ার রোগীরা নিজেদের স্বভাব এবং চালচলন অন্যদের থেকে লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করেন। যদিও প্রচুর শারীরিক এবং আচরণগত পরিবর্তন তারা লুকাতে পারেন না।

শারীরিক পরিবর্তন

  • অস্বাভাবিক ওজন কমে যাওয়া এবং ভীষণ রোগা লাগা
  • মাথা ঘোরা এবং অতিরিক্ত ক্লান্ত লাগা
  • অকারণে শীত করা
  • চুল পড়ে যাওয়া, চামড়া শুকিয়ে যাওয়া
  • অনিয়মিত ঋতুচক্র বা বন্ধ হয়ে যাওয়া

আচরণগত পরিবর্তন

  • ওজন এবং খাদ্যে ক্যালরি নিয়ে দুশ্চিন্তা, বারংবার আয়নায় নিজেকে দেখা ও ওজন মাপা
  • খিদে নেই বা খেয়ে নিয়েছি বলে পরিবারের লোকজন ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে না খাওয়া
  • খিটখিটে হয়ে যাওয়া এবং সমাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া
  • অতিরিক্ত ব্যায়াম এবং জোলাপ সেবন করে রোগা হওয়ার চেষ্টা

অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসার কারণ

এই রোগের সঠিক কারণ না জানা গেলেও নানান গবেষণায় দেখা গেছে যে, মানসিক, জৈবিক ও পরিবেশগত কারণের সংমিশ্রণ এই রোগের জন্ম দেয়। ডিপ্রেশন ও অ্যাংজাইটির কারণেও অনেকে এই পথে এগিয়ে যান। এমনকি ওসিডি থেকেও খাওয়া দাওয়া নিয়ে বাতিক দেখা দেয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিখুঁত হওয়ার চেষ্টা এবং অতিমাত্রার সংবেদনশীল মানসিকতার কারণেও এই রোগ হতে পারে।

বিভিন্ন গবেষণায় মস্তিষ্কে সেরোটিনিনের মাত্রার সঙ্গে এর সম্পর্ক দেখা গেলেও জিনগত কোনো কারণ এখনও খুঁজে না পাওয়া যায়নি।ছোট বাচ্চারা অনেক সময় ওজন নিয়ে ক্ষেপানোর কারণে বা বন্ধুদের পরামর্শে খাওয়া দাওয়া কমিয়ে দেয়। সিনেমা বা টিভিতে পাতলা হওয়াকে যেভাবে সৌন্দর্য্যের মাপকাঠি দেখানো হয়, তাও এইরকম মানসিকতার জন্ম দিতে পারে।

অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসার চিকিৎসা

যেহেতু এই রোগের প্রভাব শরীর ও মন উভয়ের ওপরেই পড়ে তাই চিকিৎসা পদ্ধতিও নানান রকমের হয়। যদি অ্যানোরেক্সিয়ার রোগী চূড়ান্ত অপুষ্টিতে ভোগেন তবে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজন হতে পারে। তবে যদি ওজন স্বাভাবিক থাকে তাহলে হাসপাতালে ভর্তি না হয়েও চিকিৎসা করানো যেতে পারে। এই প্রক্রিয়াকে চিকিৎসকরা সাধারণত তিন ভাগে করে থাকেন-

প্রথমেই, খাবার না খাওয়ার জন্যে হওয়া গুরুতর শারীরিক অসুস্থতার চিকিৎসা করা হয়।

তারপর তাদের পুষ্টিকর উপাদান দেওয়া হয়ে যাতে তারা শরীরের স্বাভাবিক ওজন ফিরে পেতে পারেন।

বাড়তি ওজনের ভয় কাটাতে কাউন্সেলিং

বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের একটি দল মিলে একসঙ্গে এই চিকিৎসাগুলো চালান। ক্ষেত্রবিশেষে রোগীর পরিবারের লোকজনেরও সহায়তা লাগে।

অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসায় আক্রান্ত ব্যক্তির যত্ন নেওয়া

আপনার পরিচিত কারোর মধ্যে যদি অ্যানোরেক্সিয়ার উপসর্গ দেখতে পান তবে সবার আগে তাদের চিকিৎসা করাতে রাজি করান। যেহেতু তারা নিজেদের সমস্যাটা মানতে চাইবেন না, তাই আপনাকে খুব শান্ত হয়ে ধৈর্য্য সহকারে বোঝাতে হবে। জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা করবেন না। যদি আপনার পরিবারের কোনো সদস্য অ্যানোরেক্সিয়াতে ভোগেন তবে বাকিরা যাতে স্বভাবিক খাওয়া দাওয়া চালিয়ে যায় সেদিকে লক্ষ রাখবেন। চিকিৎসা চলাকালীন সেটা উদাহরণ হিসেবে কাজে লাগে।

অ্যানোরেক্সিয়া সঙ্গে লড়াই

অ্যানোরেক্সিয়ার চিকিৎসা বহুদিন ধরে চলতে পারে, কাজেই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাওয়া দাওয়া চালিয়ে যাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিজেকে পরিবার ও বন্ধুদের কাছে থেকে সরিয়ে নেবেন না; তাদের সঙ্গ আপনার মন ভাল রাখতে সাহায্য করবে। অসুখ সম্বন্ধে পড়াশুনা করলে আপনি বুঝবেন যে ওজন সংক্রান্ত এই অহেতুক ভয় একটা অসুখ মাত্র। অ্যানোরেক্সিয়া রোগীদের সংগঠনে যোগদান করুন। ঘন ঘন ওজন মাপবেন না। নিজের প্রিয়জনের কথায় বিশ্বাস রেখে চললে খুব দ্রুতই আপনি সুস্থ হয়ে উঠবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *