অভিভাবকদের মধ্যে একধরনের অদৃশ্য প্রতিযোগিতাও চলে কোথাও কোথাও। একই প্রতিষ্ঠানে পড়ছে এমন শিশুর সঙ্গে, এমনকি নিজের পরিবারের কারও সঙ্গেও পাল্লা দেওয়ার ভয়াবহ মানসিকতা কারও কারও মধ্যে থাকে। নিজের জীবনের অপূর্ণ স্বপ্নের বোঝা সন্তানের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার ভুলটাও করে বসেন কেউ কেউ। অভিভাবকের এমন নেতিবাচক আচরণের প্রভাব সন্তানের ওপর কতটা পড়ে, আদতে এসব বিষয়ে কতটা শাসন করা যুক্তিযুক্ত, এ বিষয়ে জানাচ্ছেন শিশুকিশোর ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যার সহকারী অধ্যাপক ও যুক্তরাজ্যের সিনিয়র ক্লিনিক্যাল ফেলো
ডা. টুম্পা ইন্দ্রানী ঘোষ।
অতিরিক্ত শাসন ভালো নয়:
চোখ গরম করা, কড়া কথা, বকাঝকা, তিরস্কার, অন্যের সঙ্গে তুলনা, মারধর—এগুলো শিশুর জন্য নেতিবাচক। এমন শাসনে শিশু হীনম্মন্যতায় ভোগে। কড়া শাসন করা হলে বা শাস্তি দেওয়া হলে শিশু ভয় পায়। এ ধরনের আচরণ পেতে থাকলে একসময় তার আত্মবিশ্বাসটাই হারিয়ে যেতে পারে। হতাশায় ভুগতে পারে শিশু। কিছু অভিভাবক ফলাফল হাতে পাওয়া মাত্র শিশুকে তার সহপাঠীদের সামনে শাসন করা শুরু করেন। এ রকম আচরণ শিশুর আত্মমর্যাদায় আঘাত হানে।
অনেক কারণেই খারাপ হতে পারে সন্তানের ফলাফল। মেজাজ বিগড়ে গেলেও নিজেকে ঠান্ডা রাখুন। মনে রাখবেন, জীবন একাডেমিক পরীক্ষার চেয়ে অনেক বেশি বিস্তৃত। সবকিছুর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো শারীরিক ও মানসিকভাবে শিশুর ভালো থাকা। জীবনে যা কিছু নিয়ে আপনাকে অবশ্যই কৃতজ্ঞ থাকতে হবে, তার মধ্যে দারুণ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক সন্তান। এমন আচরণ করবেন না, যাতে আপনার শিশুর বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়; বরং একজন সুশিক্ষিত ও ভালো মানুষ হিসেবে তাকে গড়ে তোলার প্রতি মনোযোগ দিন। সন্তান পড়ালেখার বিষয়গুলোকে কতটা আত্মস্থ করতে পেরেছে, তা বোঝার চেষ্টা করুন। এ বিষয়ে সন্তানের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করুন। আলোচনার পরিবেশ এমন হবে, যাতে সন্তান সমস্যার কথা বলতে পারে মনপ্রাণ উজাড় করে।
কারণ খোঁজার চেষ্টা করুন:
সুন্দর জীবনের জন্য পড়ালেখা একটি আবশ্যক বিষয়। তবে পরীক্ষা কিন্তু অনেক কারণেই খারাপ হতে পারে। কারণগুলো খুঁজে বের করতে পারেন নিজের মতো করে। সে কোনো ধরনের শারীরিক কিংবা মানসিক সমস্যায় ভুগছে কি না, খুঁজে বের করুন। তার বুদ্ধিমত্তা, মনোযোগ ও আবেগপ্রবণের দিকগুলোকে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করুন। এমনও হতে পারে, হয়তো তার সহপাঠীরা তাকে কোনো কিছু নিয়ে উত্ত্যক্ত করে কিংবা পারিবারিক কোনো সমস্যায় সে বিপর্যস্ত। উঠতি বয়সী সন্তান আবেগপ্রবণ সম্পর্কের জটিলতায় ভুগছে কি না, তা বোঝার চেষ্টা করুন। তবে এ নিয়েও তার সঙ্গে খারাপ আচরণ করা যাবে না। সন্তানের পড়ালেখার বিষয়ে তার শিক্ষকদের সঙ্গে আলাপ করুন। বিভিন্ন কারণে কিন্তু মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শের প্রয়োজনও হতে পারে।
ভালো–মন্দ বিচার করুন নিজেই:
সবার মেধা সমান নয়। আর মেধাবী হলেই সবাই পরীক্ষায় প্রথম হবে না। অনেক ক্ষেত্রে চেষ্টা করেও সন্তান সর্বোচ্চ ভালো ফল করতে পারে না। সেরা ফলাফল না হলেও তার চেষ্টাকে আপনি অবশ্যই মূল্যায়ন করুন। তাকে ইতিবাচক কথা বলবেন, কটু কথা নয়। তাকে বলুন, এই ফলাফল দিয়েই জীবনে দুর্দান্ত কিছু করা সম্ভব। আপনাকেও কিন্তু বিশ্বাস করতে হবে, কোনো একটি একাডেমিক ফলাফলই কারও জীবনের সব ভালো–মন্দের নির্ধারক হতে পারে না। কারও কারও ক্ষেত্রে শাসন প্রয়োজন হলেও তা করতে হবে মধ্যম পন্থায়। বয়স অনুযায়ী পুরো বিষয়টা বুঝিয়ে বলতে হবে।
ওর মনের কথা শুনুন:
আপনার সন্তানের হয়তো একটি নির্দিষ্ট বিষয় খুব একটা পছন্দ নয়। ওই বিষয়ে সে তেমন ভালো না–ও করতে পারে। ‘তুমি পারলে না’, ‘তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না’, ‘এটা এমন কোনো কঠিন বিষয় নয়’—এ ধরনের কথা বলবেন না। ফল খারাপ হলে তার প্রতি সহমর্মী আচরণ করুন। যেখানে বিষয় বাছাইয়ের সুযোগ থাকে, সেখানে তার মতামতকে প্রাধান্য দিন। তাকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করুন। আপনার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে তাকে বাধ্য করবেন না। একটা পর্যায়ে গিয়ে হয়তো দেখলেন, সে তার ক্যারিয়ার একভাবে বেছে নিতে চাচ্ছে, কিন্তু আপনার ইচ্ছা ভিন্ন কিছু। এ ক্ষেত্রে আপনি অবশ্যই তার ভাবনার কথা শুনবেন। তার ভাবনার ভালো–মন্দ দিক নিয়ে আলোচনাও করতে পারেন। কিন্তু তার ভাবনাটিকে সম্মান করা অভিভাবক হিসেবে আপনার দায়িত্ব।