কখনো হিমশীতল পাহাড়ে, কখনো সাইকেলে কেটেছে ঈদ

প্রিয়জনের সান্নিধ্যে ঈদ কাটাতে চান সবাই। নিজ বাড়িতে, পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদ্‌যাপনের আনন্দই আলাদা। তবে প্রিয়জন থেকে দূরে, অন্য এক ‘প্রিয়’র সান্নিধ্যেও কেটেছে আমার বেশ কয়েকটা ঈদ। সেই ‘প্রিয়’র নাম—অ্যাডভেঞ্চার। রোমাঞ্চ।কখনো পর্বতের পাদদেশে ট্রেকিং করে, কখনো পর্বত আরোহণ করে, কখনোবা সাইকেলের দুই চাকায় ভর করে মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিতে দিতে কেটেছে কত ঈদ! লিখতে বসে মাথায় ভিড় করছে এমন অনেক স্মৃতি। অবশ্য কালের ধূলির নিচে চাপা পড়া ঈদের স্মৃতিও কম নয়। ঈদের দিন পাহাড়ে থাকলে চেষ্টা করি পরিষ্কার জামাকাপড় পরতে। অবশ্য সেটাও ভাগ্যে জোটে কই? পাহাড়ে যাওয়ার সময় কাঁধের ব্যাগটা যে অনেক হিসাব–নিকাশ করে গোছাতে হয়। প্রয়োজনের বাইরে এক গ্রামও বহন করতে চাই না। সে ক্ষেত্রে চেষ্টা করি লাদাখিদের অনুসরণ করতে। ঠান্ডা মরুভূমি হিসেবে পরিচিত লাদাখের অধিবাসীরা ঠান্ডা থেকে বাঁচতে সবচেয়ে নোংরা জামাখানা পরে বাইরের দিকে। তবে কোনো উৎসবের সময় পাল্টে দেয় এই ক্রম। সে ক্ষেত্রে সবার বাইরে শোভা পায় সবচেয়ে কম নোংরা জামা। পর্বতে ঈদ পড়লে লাদাখিদের এই ক্রম অনুসরণ করি। নিজেকে কিছুটা পূতপবিত্র মনে হয় এতে করে!গত ঈদটা দুনিয়ার সবচেয়ে উঁচু পর্বতের পাদদেশ, তথা এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে কেটেছে। হিমবাহ গলা শীতল পানিতে মোজা ধুয়ে দিনটা কেটেছিল। পানি ঘাঁটাঘাঁটি করে অস্নানজনিত কুবাস কিছুটা হলেও কাটানো গিয়েছিল। পাহাড়ে ডিটারজেন্টে ধোয়া মোজা পরার আনন্দ ঈদের নতুন জামাকাপড় পরার আনন্দের চেয়ে কোনো অংশে কম না। মনে হয় খোলস পালটে বেরিয়ে এসেছে নতুন পা।

গত ঈদটা দুনিয়ার সবচেয়ে উঁচু পর্বতের পাদদেশ, তথা এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে কেটেছে। হিমবাহ গলা শীতল পানিতে মোজা ধুয়ে দিনটা কেটেছিল। পানি ঘাঁটাঘাঁটি করে অস্নানজনিত কুবাস কিছুটা হলেও কাটানো গিয়েছিল। পাহাড়ে ডিটারজেন্টে ধোয়া মোজা পরার আনন্দ ঈদের নতুন জামাকাপড় পরার আনন্দের চেয়ে কোনো অংশে কম না। মনে হয় খোলস পালটে বেরিয়ে এসেছে নতুন পা।পাহাড়ে ঈদ নিয়ে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্মৃতি হিমাচল প্রদেশে। সেবার ঈদের দিনে এক অনামী শৃঙ্গের অ্যাডভান্স ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়েছিলাম। মালবাহক কিংবা গাইডের সাহায্য ছাড়াই স্বনির্ভর পদ্ধতিতে আরোহণ করছিলাম আমি ও আমার এক সহযাত্রী। পথ ভুলে প্রচলিত পথ থেকে দূরে সরে গিয়েছিলাম। আরোহণের আনন্দে মত্ত থাকাতেই এই ভুল। যখন বুঝতে পারলাম, তখন অনেকটাই দূরে সরে এসেছি।

সামনে পাহাড়ের গাত্রে একটা সংকীর্ণ খাঁজ অপেক্ষা করছিল। সেটা বেয়েই আরোহণ করছিলাম দুজন। খানিক বাদে বুঝতে পারলাম কী এক বিভীষিকায় পা রেখেছি! ওপর থেকে ক্রমাগত পাথর গড়িয়ে পড়ছিল। এদের কোনোটার যাত্রাপথে পড়লে হাজারখানেক ফুট নিচের হিমবাহ হবে আমাদের গন্তব্য। পায়ের দিকে দৃষ্টি দেওয়ার বদলে ওপরের দিকে দৃষ্টি রাখতে হচ্ছিল বেশি। প্রতিটা ক্ষণে স্নায়ুর ওপর কী বিষম চাপ! সন্তর্পণে সেই সংকীর্ণ খাঁজের কিনার ঘেঁষে উঠছিলাম আর কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছিলাম, কোনো পাথর যাতে পায়ের চাপে হড়কে না যায়! ঘুমিয়ে থাকা এসব পাথরকে পায়ের চাপে জাগিয়ে দিলে আমার বেশ কিছুটা নিচে থাকা সহযাত্রীর বিপদের সমূহ আশঙ্কা আছে। ভাগ্য বেশিক্ষণ সহায় হয়নি। এক অসতর্ক মুহূর্তে আমার পায়ের চাপে স্থানচ্যুত হলো মাঝারি আকৃতির একটা পাথর। পলকেই দুদ্দাড় গতিতে যাত্রা করল সেই উপল খণ্ড। মাধ্যাকর্ষণের টানে নিম্নমুখী সে যাত্রায় প্রতি মুহূর্তেই পাথরটার গতি বাড়ছিল। সোজা আমার সহযাত্রীর অভিমুখে গতিপথ। আমার তারস্বরে চিৎকার সহযাত্রীর কান অবধি পৌঁছালেও শারীরিক প্রতিক্রিয়া দেখানোর সময় পেল খুব কম। শিরদাঁড়ায় সরীসৃপ বেয়ে ওঠার অনুভূতি নিয়ে আমি তখন চরম উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়ে আছি নিচে। শেষ মুহূর্তে সহযাত্রী পাথরের গতিপথ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেও কাঁধের ব্যাকপ্যাকের পাশে ঝুলতে থাকা স্লিপিং ম্যাটটার শেষ রক্ষা হলো না। ব্যাকপ্যাকের স্ট্র্যাপ থেকে খসিয়ে হাজার ফুট নিচের হিমবাহে হারিয়ে গেল। আমার সহযাত্রীরও ঠিক একই দশা হতে পারত!

কানের পাশ দিয়ে না হোক, ব্যাকপ্যাকের পাশ দিয়ে গুলি গেল যেন! ঈদের দিনে এমন দুর্ঘট দূরতম কল্পনায়ও ছিল না। এই আকস্মিক পাথর গড়িয়ে পড়ার পর আরও সাবধান হয়ে গিয়েছিলাম আমরা। অতি সন্তর্পণে আরোহণ করে পৌঁছেছিলাম অ্যাডভান্স বেস ক্যাম্পে। দুর্ভেদ্য চক্রব্যূহ ভেদের আনন্দ হয়েছিল আর কোনো দুর্বিপাক ছাড়াই অ্যাডভান্স বেস ক্যাম্প পৌঁছে।

সাইকেলের সিটে বসে কেটেছিল ২০২৩ সালের ঈদ। সেবার যাচ্ছিলাম ভারতের সর্ব উত্তরের শ্রীনগর থেকে সর্ব দক্ষিণের কন্যাকুমারী। ঈদের দিনে দুই চাকায় চেপে আকবরের সমাধি হয়ে তাজমহল আর আগ্রা দুর্গ দেখে এসেছিলাম। বাড়ি থেকে দূরে থাকলেও পাহাড়ের গহনলোকের বদলে জনপদে থাকায় পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল। মা-বাবাকে ভিডিও কলে দেখিয়েছিলাম তাজমহল। সেই প্রথম যৌবনে মা-বাবার দেখা শ্বেতপাথরের এই বিস্ময়ের সঙ্গে ফের দেখা করিয়ে দিতে পারার আনন্দ কম নয়। ওদের চোখেমুখে আনন্দের ছটা দেখতে পারাটা আমার চোখে অনেক দিন লেগে থাকবে। অবশ্য সেই আনন্দের ছটার উৎস সম্রাট শাহজাহানের শ্বেতমর্মর দেখার আনন্দ নাকি ভিনদেশ থেকে ঈদের এই উৎসবে নিজের আত্মজকে দেখার আনন্দ—তার খবর কে রাখে!

এই লেখাটা লিখছি বাড়ি থেকে দূরে হিমালয়ের গহনলোকের এক পাহাড়ি জনপদ থেকে। লেখার সময়েও দুয়ারে কড়া নাড়ছে ঈদ। এবারের ঈদও হিমালয়ের গহনলোকে উত্তুঙ্গ পর্বতসারির হিমশীতল সান্নিধ্যে কাটবে। প্রিয়জনদের উষ্ণতার চেয়ে এই শীতলতার সান্নিধ্য আমার কাছে কম মূল্যবান নয়। বড় হতে হতে ঈদকে ঘিরে ছোটবেলার আবেদন কমে গেলেও এই উৎসবকে ঘিরে নিজের মনোজগতে নস্টালজিয়া কমছে কই?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *