এক সময় দেশের সীমানাতেই সীমাবদ্ধ ছিল বাংলাদেশি সিনেমার স্বপ্ন। বর্তমানে সেই স্বপ্ন পেরিয়ে গেছে মহাদেশ, ভাষা আর সংস্কৃতির গণ্ডি। বাণিজ্যিক ধারার সিনেমা বিশ্বের নানা দেশের মাল্টিপ্লেক্সে দর্শক টানছে, আর ঢাকার বিকল্প ও শিল্পঘরানার ছবি আন্তর্জাতিক উৎসবের লালগালিচায় হেঁটে নিচ্ছে সম্মান। শুধু অংশগ্রহণেই থেমে নেই এই যাত্রা–বিশ্বের নামকরা চলচ্চিত্র উৎসব থেকে পুরস্কার নিয়ে ফিরছে বাংলা সিনেমা। এই বিস্তার জানান দিচ্ছে, বাংলাদেশি সিনেমা এখন আর কেবল স্থানীয় বিনোদন নয়; এটি বৈশ্বিক আলোচনার অংশ। আন্তর্জাতিক এই যাত্রার এবার যাত্রী হচ্ছে ঢাকার তিনি সিনেমা–‘রইদ’, ‘দেলুপি’ ও ‘মাস্টার’। তিন ধরনের গল্পের এই তিন সিনেমার গন্তব্য এবার একই উৎসবে।
এদিকে শীতের শেষে, ইউরোপের আকাশে যখন কুয়াশা জমে, তখন নেদারল্যান্ডসের রটারড্যাম শহর আবারও হয়ে ওঠে বিশ্বের সিনেমাপ্রেমীদের মিলনমেলা। নতুন বছরের ২৯ জানুয়ারিতে এই দেশটিতেই শুরু হতে যাচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল রটারড্যামের ৫৫তম আসর। চলবে ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। সেই উৎসবের আলোছায়ার ভেতর দিয়ে হাঁটতে যাচ্ছে বাংলাদেশের রইদ, মাস্টার ও দেলুপি।
এই তিন ছবির যাত্রা কেবল উৎসবভ্রমণ নয়, এটি সমকালীন বাংলা সিনেমার আত্মপরিচয়ের এক নতুন অধ্যায় হিসেবেই দেখছেন বাংলা সিনেমাবোদ্ধারা। সিনেমাটির গল্প নিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে আছেন আদিম আখ্যানের ধ্বংসস্তূপে, কেউ স্থানীয় রাজনীতির আঁধার-আলোয়, কেউ আবার প্রান্তিক মানুষের নীরব জীবনের ভেতরে।
প্রিমিয়ার ও রটারড্যামের টাইগার কম্পিটিশনে রইদ:
মেজবাউর রহমান সুমনের নাম উচ্চারণ হলেই এখনও ভেসে ওঠে ‘হাওয়া’। প্রথম ছবিতেই তিনি যে বিস্ময়ের ঢেউ তুলেছিলেন, তার রেশ কাটতে না কাটতেই তিন বছর পর আসছে দ্বিতীয় ছবি রইদ। রটারড্যাম উৎসবেই এই ছবির প্রিমিয়ার। অংশ নিচ্ছে উৎসবের মূল প্রতিযোগিতা বিভাগ টাইগার কম্পিটিশনে; যা বাংলাদেশের পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমার ইতিহাসে এক অনন্য অর্জন।
রইদ-এর গল্প বাহ্যত খুব সরল। সাধু, তাঁর পাগল স্ত্রী আর বাড়ির পাশের একটি তালগাছ–এই তিনকে ঘিরেই আবর্তন। এই সরলতার ভেতর দিয়েই হাজার বছরের আদিম গল্প তুলে ধরেছেন নির্মাতা। মেজবাউর রহমান সুমনের ভাষায়, ‘সাধু, তাঁর পাগল স্ত্রী এবং তাদের বাড়ির পাশের তালগাছকে ঘিরে আবর্তিত এই গল্পে আমরা আদতে হাজার বছরের পুরোনো আখ্যানকে বর্তমানে পুনর্নির্মাণ করেছি। তবে সময়ের বর্তমানে নয়; বরং অনুভূতির বর্তমানে। এই ছবির প্রতিটি স্তরে জড়িয়ে আছে চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের দেখা গ্রামীণ বাংলার আবহ।’
এই ছবির প্রতিটি ফ্রেমে যেন গ্রামীণ বাংলার গন্ধ। চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের ক্যানভাস থেকে উঠে আসা পেশিবহুল কৃষক, বিস্তীর্ণ মাঠ, নিঃসঙ্গ আকাশ। মোস্তাফিজ নূর ইমরান, নাজিফা তুষি, গাজী রাকায়েতদের অভিনয়ে সেই অনুভব আরও গভীর হয়েছে। বঙ্গ প্রযোজিত এই সিনেমা উৎসব শেষে দেশের হলে মুক্তি পাবে–সে অপেক্ষায় এখন দর্শক।
রটারড্যামের বিগ স্ক্রিন কম্পিটিশন বিভাগে ‘মাস্টার’
একই উৎসবে, ভিন্ন সুরে কথা বলবে রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিতের মাস্টার। রাজনৈতিক থ্রিলার ঘরানার এই ছবি প্রতিযোগিতা করবে রটারড্যামের বিগ স্ক্রিন কম্পিটিশন বিভাগে। গল্পের কেন্দ্রবিন্দু এক শিক্ষক–জহির আহমেদ। সমাজসেবায় জনপ্রিয় এই মানুষটি হঠাৎই স্থানীয় রাজনীতির টানাপোড়েনে জড়িয়ে পড়েন। উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থীর অভাব। তখন এলাকাবাসীর অনুরোধে ভোটে দাঁড়ান জহির। জয় পান, হন চেয়ারম্যান। ক্ষমতা মানুষের ভেতরের মানুষটিকে কোথায় নিয়ে যায়–সেই প্রশ্নই মাস্টারের মূল সুর। নাসির উদ্দিন খানের সংযত অথচ শক্ত অভিনয়ে জহির চরিত্রটি যেন আমাদের চেনা অনেক মুখের প্রতিচ্ছবি। আজমেরী হক বাঁধন, জাকিয়া বারী মম, ফজলুর রহমান বাবু, লুৎফর রহমান জর্জরা ছবির রাজনীতিকে আরও বাস্তব করে তুলেছেন। উল্লেখযোগ্য বিষয়, সরকারি অনুদানে নির্মিত এই ছবির শুটিং-পরবর্তী কাজ হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। আন্তর্জাতিক কারিগরি সহযাত্রা মাস্টারকে দিয়েছে আলাদা মাত্রা। এটি কেবল একটি রাজনৈতিক গল্প নয়, বরং ক্ষমতা ও নৈতিকতার সংঘর্ষের এক নির্মম পাঠ।
ব্রাইট ফিউচার বিভাগে দেলুপি
এই দুই নতুন ছবির পাশে রটারড্যামে যাচ্ছে আরেকটি আলাদা স্বরের সিনেমা–মোহাম্মদ তাওকীর ইসলামের দেলুপি। গত নভেম্বরে দেশের হলে মুক্তি পাওয়া ছবিটি ইতোমধ্যে দর্শক ও সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। এবার রটারড্যাম উৎসবের ব্রাইট ফিউচার বিভাগে হবে এর আন্তর্জাতিক প্রিমিয়ার।
দক্ষিণাঞ্চলের এক ইউনিয়নের মানুষের জীবন থেকে উঠে এসেছে দেলুপি। এখানে নেই পরিচিত তারকা, নেই চমকপ্রদ মোড়। আছে নদীঘেরা জনপদ, সম্পর্কের টানাপোড়েন আর জীবনের নীরব লড়াই। স্থানীয় মানুষদের অভিনয়ে নির্মিত এই ছবি যেন ডকুমেন্টারি আর ফিকশনের মাঝামাঝি এক মানবিক ভাষা।
পরিচালক তাওকীর ইসলামের কাছে এই যাত্রা আবেগের। কারণ, তিনি কথা দিয়েছিলেন দেলুটি ইউনিয়নের মানুষদের–ছবিটি তারা আগে দেখবে। সেই প্রতিশ্রুতি রেখেই দেশের মুক্তির পর আন্তর্জাতিক পর্দায় পা রাখছে দেলুপি। এটি প্রমাণ করে, শিকড়ের সঙ্গে সৎ থাকলেও বিশ্বদরবারে পৌঁছানো যায়।
তিন সিনেমার এক গন্তব্য
রইদ, মাস্টার আর দেলুপি–তিনটি সিনেমা তিন রকম পথে হাঁটছে। একটিতে আছে মিথ ও অনুভূতির পুনর্নির্মাণ, একটিতে ক্ষমতার রাজনীতি, আরেকটিতে প্রান্তিক জীবনের নীরব কবিতা। কিন্তু গন্তব্য এক–বাংলাদেশি সিনেমাকে আন্তর্জাতিক মানচিত্রে আরও দৃঢ়ভাবে স্থাপন করা। রটারড্যামের পর্দায় যখন এই তিন গল্প একে একে ফুটে উঠবে, তখন এটি হবে বাংলাদেশের সিনেমার জন্য একটি বিরল ঘটনা।