পঁচিশে প্রকাশিত নতুন দুটি লিটলম্যাগ

চট্টগ্রাম থেকে এবছর (২০২৫) আগস্ট ও অক্টোবরে প্রকাশিত হলো নতুন দুটি লিটলম্যাগ। লিটল ম্যাগের সংজ্ঞায় বাংলাপিডিয়া বলছে: ‘শিল্পসাহিত্য ও জ্ঞান–বিজ্ঞান বিষয়ে চলমান ধারাকে চ্যালেঞ্জ করে ব্যতিক্রমধর্মী চিন্তাধারা ও মতামত ব্যক্ত করার মুদ্রিত বাহনকে বলা হয় লিটলম্যাগ’। ম্যাগজিন শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ভিন্ন হলেও লিটলম্যাগের সাথে কিছু সাদৃশ্য আছে। ম্যাগাজিন একটি বারংবার আগ্নেয়াস্ত্রের জন্য একটি গোলাবারুদ সংরক্ষণ এবং খাওয়ানোর ডিভাইস, এটি বন্দুকের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য বা বাহ্যিকভাবে সংযুক্ত। লিটলম্যাগের সাথে ছোট বন্দুক বা পিস্তলের ক্ষমতার একটি সাদৃশ্য আছে। সামরিক শক্তির সাথে তাই শিল্পশক্তি নিয়ে সংগ্রামে সক্ষম লিটলম্যাগ–গোষ্ঠী। লিটলম্যাগ শিল্পচর্চার মাধ্যমে সমাজ–রাষ্ট্রের ইতিবাচক পরিবর্তনের স্বপ্ন লালন করে এবং প্রায়শ তা বাস্তবায়ন করে তারুণ্যের শক্তি দিয়ে। কবি বুদ্ধদেব বসু এ–সম্পর্কে লেখেন: ‘এটি কখনো মন যোগাতে চায়নি, মনকে জাগাতে চেয়েছিল। চেয়েছিল নতুন সুরে নতুন কথা বলতে। কোনো এক সন্ধিক্ষণে যখন গতানুগতিকতা থেকে অব্যাহতির পথ দেখা যাচ্ছে না, তখন সাহিত্যের ক্লান্ত শিরায় তরুণ রক্ত বইয়ে দিয়েছিল–নিন্দা নির্যাতন বা ধনক্ষয়ে প্রতিহত না হয়ে। এই সাহস, নিষ্ঠা, গতির একমুখিতা, সময়ের সেবা না করে সময়কে সৃষ্টি করার চেষ্টা এটাই লিটল ম্যাগাজিনের কুলধর্ম’। এই কুলধর্মকে আলিঙ্গন করেই বাংলা–সংস্কৃতির চারণভূমি চট্টগ্রামে আবির্ভূত হয়েছে অণু (আগস্ট ২০২৫) আর কথাকোবিদ (অক্টোবর ২০২৫) নামে দুটো লিটল ম্যাগ।

মানুষের পক্ষে ভাষা–সাহিত্য–শিল্প–সংস্কৃতি এগুলোর চর্চা এবং আস্বাদন অসম্ভব হত যদি সে সামাজিক জীব না হতো। আবার সামাজিক সংগঠন গড়ে উঠেছে পরিবার গঠনের কারণে। এই পরিবার এসেছে মানুষের বিবাহ প্রথা প্রচলিত হবার ফলে। বিবাহ সংখ্যা দিয়ে অণু (শিল্পসাহিত্য–বিষয়ক ছোটোকাগজ) এর সূচনা সংখ্যা সম্পাদনা করেছেন কবি অনুপমা অপরাজিতা। বিবাহ বিষয়ক বিচিত্র শিল্পসৃষ্টি নিয়ে তেইশজন লেখকের ভাবনা একমলাটে তিনশতাধিক পৃষ্ঠা অফসেট পেপার প্রিন্টের ছোটকাগজটির সূচিপত্রে শুরুতে আছে: সম্পাদকীয়–প্রথম যাত্রা নিয়ে কিছু কথা। এরপরেই স্বনামধন্য কবি ময়ুখ চৌধুরীর একটি অপ্রকাশিত কবিতা দিয়ে। এক বিমূঢ় বেদনায় বিমোহিত হয়ে বিরহকাতর পাঠকের মনে প্রশ্ন প্রশ্ন জাগে:

‘কিছুই ছিল না মনে, তবু কেন মুছেছিলে ঘাম?

তবু কেন কেঁদেছিলে দেখে তুমি বিয়ের এলবাম!’

বিয়েবিষয়ক আরও দুটি চমৎকার কবিতা লিখেছেন–কবি রিজোয়ান মাহমুদ ও শেলী নাজ। আর বিয়ের বিচিত্র ব্যবহার–বিন্যাস উপজীব্য করে গল্প লিখেছেন: ‘ছায়া–অভিসার’–ফেরদৌস আরা আলীম, ‘যুদ্ধদিনের বিয়ে’–শোয়ায়েব মুহামদ, ‘চিৎকার’–মণিকা চক্রবর্তী এবং ‘ককবরক’–মুয়িন পারভেজ। লিটলম্যাগে প্রকাশিত প্রায় প্রত্যেকটি প্রবন্ধ পাঠককে নতুনভাবে বিয়ে নিয়ে ভাবতে অনুপ্রাণিত করে; শিরোনাম পাঠেই শিহরণ জাগে। প্রাবন্ধিক ও প্রবন্ধের নামে চোখ বুলানো যাক: ‘মানবসভ্যতার ঊষালগ্ন এবং পরিবারপ্রথার উৎপত্তি ও বিবাহ’–রাহমান চৌধুরী, ‘বিবাহপ্রথা: একটি হোমো স্যাপিয়েন্স–দৃষ্টিপাত’–হাফিজ রশিদ খান, ‘দুই ধ্রুপদি কবির বিয়ে আর কবি হয়ে ওঠার গল্প’–জ্যোতির্ময় নন্দী, ‘বাঙালির বিয়ে ও যৌনজীবন: প্রেক্ষিত ও পরম্পরা’–রণদীপম বসু, ‘বিয়ে ও রাজনীতি’–খালেদ হামিদী, “দাম্পত্যসম্পর্কে ‘সার্থকতা’ প্রসঙ্গে”–সিদ্ধার্থ বসু, ‘বিয়ের পদ্য এবং কবিদের কবিতা’–চিত্ত মণ্ডল, ‘বাংলা চলচ্চিত্রে বিবাহ’–শৈবাল চৌধূরী, ‘আদিবাসী বিয়ের দেশবিদেশ’–সেলিনা শেলী, ‘বীরভূমের মুসলমান বিবাহরীতি’–আয়েশা খাতুন, ‘বিবাহের মনস্তত্ত্ব ও লালনভাবনা’–স্বপন মজুমদার এবং ‘বাঙালির বিয়ে বাঙালির সম্পদ হারিয়ে যায়’–শুভেন্দু দেবনাথ।

অনুবাদ রচনাদুটি ছোটোকাগজটি পাঠের আগ্রহ আরও বাড়িয়ে দেয়। ‘ঔপনিবেশিক বাংলায় এক মুসলিম পরিবারের আত্মপরিচয়: স্মৃতি আর ইতিহাসের দোলাচল’, মোহাম্মদ রশীদুজ্জামানের লেখাটি অনুবাদ করেছেন জি এইচ হাবীব; আর ‘বিয়ে–প্রেমের কফিন’– ওশো ও বিতর্ক–উসকানো দার্শনিক রচনার সুখপাঠ্য অনুবাদ করেছেন নিয়ামুন নাহার। গ্রন্থালোচনা অংশে ভারতের বিখ্যাত সমাজগবেষক সুকুমারী ভট্টাচার্যের বিবাহ প্রসঙ্গে (১৯৯৬) বইয়ের আলোচনা: ‘নারীমুক্তিচেতনার এক অসামান্য দলিল’–অপর্ণা ঘোষ, ম্যাগাজিনের মানে আন্তর্জাতিকতা এনেছে। সুকুমারির মতে, পৃথিবীর ইতিহাসে–বিবাহ নরনারীর যৌনসম্পর্ক বিবর্তনে ও নানা পরীক্ষা–নিরীক্ষার ইতিহাসে সম্ভবত শেষতম ধাপ, যেখানে পৌঁছে নরনারীর সমাজস্বীকৃত সম্বন্ধ বহুকাল যাবৎ স্থির আছে’। এভাবে এই লিটলম্যাগটি তার পাঠকের সামনে এটি মুক্তবুদ্ধি ও ভিত নির্মাণ করে তাকে মুক্তচিন্তার উদ্বুদ্ধ করে প্রতিনিয়ত।

মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রথম উপাদান অন্ন; বাঙালির প্রিয় এবং প্রধান খাদ্য ভাত। ফলে বাঙালির ইতিহাস–ঐতিহ্য–সাহিত্য–সংস্কৃতির সাথে জড়িয়ে আছে ‘ভাত’ প্রসঙ্গ। তবু ভাত বিষয়ক কোনো লিটলম্যাগ দুই বাংলায় চোখে পড়েনি। তাই স্বাতন্ত্যচেতনায় অভিসিক্ত ভাত বিষয়ক প্রাতিস্বিক লিটলম্যাগ কথাকোবিদ (অক্টোবর ২০২৫) সম্পাদনা করেন কথাসাহিত্যিক ও গবেষক ড. আজাদ বুলবুল। উদ্বোধনী সংখ্যাটি চুয়াল্লিশ জন স্বনামধন্য লেখকের বিচিত্র ভাবনায় বিন্যস্ত। বরেণ্য সম্পাদক বুলবুল বিষয়সূচিকে সাতটি উপসূচিতে সাজিয়েছেন সুনিপুণ মুন্সীয়ানায়। প্রথমে ‘ভাত বৃত্তান্ত’ শিরোনামে এক ডজন প্রবন্ধে ভাতের ইতিহাস–ঐতিহ্যের অনুসন্ধানে আছে: ‘ভাত–বন্দনা’–মানবর্দ্ধন পাল, ‘ভাত নিয়ে বাতচিৎ’–গোলাম শফিক, ‘ভাতের সূত্রে ধান–গম সংস্কৃতির কথা’–আবুল মোমেন, ‘ভাত পুরাণ’–গাজী আজিজুর রহমান, ‘ধান চাল ভাত নিয়ে এলোমেলো কথা’–সমর পাল, ‘ভাতের উৎসব কিংবা উৎসবের ভাত’–ওমর কায়সার, ‘ভাতে হাভাতে’–ইমতিয়ার শামীম, ‘বিচিত্র জালে ভাতের ভাবনা’–স্বপন নাথ, ‘ভাতের কথা, উপকথা ও ইতিকথা’–হামীম কামরুল হক, ‘ভাতের ইজ্জত’–মৃত্তিকা চাকমা, ‘ভাত কাহন’–শামসুদ্দীন শিশির এবং ‘গট গট গট’–জাহেদ মোতালেব। এর মধ্যে কোনো রচনায় স্মৃতিকাতরতাও ভর করেছে বৈকি। ‘ভাতের লড়াই’ উপশিরোনামে আছে সাহসী দুটি প্রবন্ধ। ‘ভাতের সংগ্রাম: আমাদের কৃষক ও কৃষকের কষ্ট’–ফরিদ আহমদ দুলাল এবং ‘ভাতের অধিকার’–মোঃ সালেহ মাহমুদ। ‘সৃজনকলায় ভাত’ উপশিরোনামে নয়টি নিবন্ধে বর্ণিত হয়েছে শিল্পসাহিত্যেও বিভিন্ন শাখায় ভাতের বহুমুখী ব্যবহারের বিবরণ। এধারার প্রবন্ধগুলো হচ্ছে: ‘বাংলা সাহিত্যে ভাত ও ভাতের ইতিকথা’–তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী, ‘বাংলা চলচ্চিত্রে ভাত’–শৈবাল চৌধূরী, ‘বাংলা নাটকে অন্নসংকট’–অরূপ বড়ুয়া, ‘ইতিহাস সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ভাত’–খালেদ হামিদী, ‘বাংলা ছড়াসাহিত্যে ভাত প্রসঙ্গ’–রাশেদ রউফ, ‘বাংলা কথাসাহিত্যে ভাত: ক্ষুন্নিবৃত্তির সাহিত্যিক ভাষ্য’–আহমেদ মাওলা, ‘বাংলা লোকসাহিত্যে ভাতের প্রসঙ্গ’–শামসুল আরেফীন, ‘বাংলা গানে ভাত’–মহি মুহাম্মদ এবং ‘চিত্রকলায় বাংলার দুর্ভিক্ষ: ভাতের মর্মন্তুদ উপস্থাপন’–শিশির মল্লিক।

আঞ্চলিক সাহিত্য–সংস্কৃতিতে ভাত বিষয়ক বাতচিত আছে ‘ভাতের ভূগোল’ উপশিরোনামের ছয়টি রসালো প্রবন্ধে। এগুলো হলো: ‘ভাত জেলেদের ঈশ্বর’–হরিশংকর জলদাস, ‘ফরিদপুরের ঐতিহ্যবাহী লোকখাদ্য: ভাত’–ড. মাসুদ রেজা, ‘শংখপাড়ের ভাতের গল্প’–অভীক ওসমান, ‘নোয়াখালীর লোকসাহিত্যে ভাত’–ম. পানাউল্লাহ, ‘উত্তরবঙ্গের হাভাতে’–নূরুননবী শান্ত এবং ‘মঙ্গা কবলিত বগুড়ার সাগটিয়ায় ভাতের কষ্ট’–ইসলাম রফিক। ‘আদিবাসী সংস্কৃতিতে ভাত’ উপসূচিতে আছে: ‘ভাতের রস: আদিবাসী খাদ্য সংস্কৃতির আমুদে উপাচার’–আজাদ বুলবুল, ‘খমং’ মারমাদের প্রধান আহার্য’–মংক্য শোয়েনু নেভী, ‘চাকমা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ভাত’–শাওন ফরিদ, ‘মারমা আদিবাসীর লোকধর্ম ও গার্হস্থ্য জীবনে ভাত’–উচিমং চৌধুরী এবং ‘চাকমা লোকধর্মে ভাত’–বিপম চাকমা এই পাঁচটি প্রবন্ধ। ‘ভাতের বিজ্ঞান ও অন্যান্য’ উপসূচিতে আছে: ‘ভাত রসায়ন’–মৃত্যুঞ্জয় রায়, ‘নুন–পান্তা সংস্কৃতি বনাম পান্তা–ইলিশ’–হোসাইন কবির, ‘বাঙালির লোকসংস্কৃতিতে পান্তাভাত’–শাকিল আহমদ, ‘মোচা: বৃহত্তর চট্টগ্রামের লোকখাদ্য ও লোকসংস্কৃতি’–আলী প্রয়াস এবং ‘ভাত শব্দের বাগর্থতত্ত্ব’–ড. শ্যামল কান্তি দত্ত এই পাঁচটি বিজ্ঞানমনস্ক প্রবন্ধ। সবশেষে আছে ‘ভাতের গল্প’ অংশে চমৎকার পাঁচটি ছোটগল্প। গল্পগুলো লিখেছেন–রফিকুর রশীদ, বাদল সৈয়দ, সানাউল্লাহ নূর এবং মথুরা ত্রিপুরা। তবে দেয়াঙ লিটলম্যাগ সম্পাদক মাহমুদ নোমান রচিত ‘তোফাজ্জল ভাত খেয়ে মারা গেছে’ শিরোনামের ঐতিহাসিক ছোটগল্পটি পাঠককে সমকালীন ইন্টেরিমের দিকে আঙুল দেখাবে। ভাতবিষয়ক এমন আরও বিচিত্র ভাবনায় পাঠক অবগাহন করবেন এই লিটলম্যাগ পাঠের কল্যাণে। কথাকোবিদ–এর লেখক পরিচিতি পাঠে অণু–ও অভাবটি অনুভূত হয়। তবে দেশের রাজধানী থেকে দূরবর্তী চট্টগ্রাম থেকে চমৎকার দুটি ছোটকাগজ আমাদের অনুপ্রাণিত করে ম্যাগাজিন দুটো পাঠ করতে এবং সংগ্রহ রাখতে। সর্বোপরি লিটলম্যাগ দুটির পাঠকপ্রিয়তা ও প্রকাশনা দীর্ঘজীবী হোক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *