‘হামজা সত্যিকারের নেতা, দেশের সম্পদ’

এক হামজা চৌধুরীর আবির্ভাবেই বাংলাদেশের ফুটবল তথা ক্রীড়াঙ্গন জেগে উঠেছে। ভেঙে পড়া ফুটবল আবারও কোমর সোজা করে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন বুনছে। এই স্বপ্ন বেগবান হয়েছে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকে দীর্ঘ ২২ বছর পর হারানোর পর। মঙ্গলবার রাতে ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামে ঐতিহাসিক জয়ের কারিগর ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলা তারকা হামজা। তাঁর ছোঁয়ায় পুরো দল জেগে ওঠে। যার প্রমাণ মিলেছে রাকিব হোসেন, শেখ মোরসালিনদের দুর্দান্ত পারফরমেন্সে। ভারত বধের পর এখন সবার মুখেই একই কথা, ‘হামজা সত্যিকারের নেতা, দেশের সম্পদ।’ 
ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচ শেষের বাঁশি বাজতেই ডাগআউট থেকে কোচ, খেলোয়াড়, টিম স্টাফ সবাই ছুটে আসেন মাঠে। কেউ জয়ের নায়ক শেখ মোরসালিনকে, কেউ হামজা চৌধুরীকে আলিঙ্গনে বাঁধেন। সব ক্লান্তি ঝেরে জয়ের আনন্দে মাতোয়ানা হন মিতুল-তপুরা। গ্যালারি মুখরিত করে রাখেন ফুটবলপ্রেমীরা। মাঠে সবকিছু উপভোগের পর সংবাদ সম্মেলনে এসেও যেন একই ছবি দেখেন হামজা। গণমাধ্যমকর্মীরা যে করতালিতে সম্মেলন কক্ষে বরণ করে নেন হামজাকে। তৃপ্তির হাসি চোখেমুখে ফুটিয়ে ইংল্যান্ড প্রবাসী এই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার বলেন, ‘এটি অবশ্যই আমার ক্যারিয়ারের সেরা সাফল্যের মধ্যে থাকবে।’

প্রাণখোলা হাসিতে কঠোর পরিশ্রমের আর অনেক প্রচেষ্টার ফল পাওয়ার অনুভূতি জানিয়ে হামজা বলেন, ‘আমি ম্যাচের পরই বলেছি, আমি তো আসলে ক্যাম্পে একেবারে শেষে যোগ দিয়েছি। কোচ, কোচিং স্টাফ আর খেলোয়াড়রা প্রায় ২৩ দিন ধরে এখানে আছে- কোচ বলেছেন পাঁচশ’ ঘণ্টারও বেশি। পরিবার থেকে দূরে, হোটেলে থেকে দেশের জন্য, পরিবারের জন্য কঠোর পরিশ্রম করে গেছে সবাই। আলহামদুলিল্লাহ তার ফল মিলেছে।’
বর্তমানে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে সেরা তারকা বলেন, ‘দলের সঙ্গে আমি আর সামিত একটু দেরিতে যোগ দিয়েছি। এসে শুধু কিছুটা মান, কিছুটা মানসিকতা যোগ করার চেষ্টা করেছি। আমরা সেই মানসিকতাই দেখিয়েছি। শেষ চার ম্যাচে আমরা দারুণ খেলেছি, ট্যাকটিক্যালি খুব ভালো ছিলাম। কিন্তু শেষ ধাপে বারবার হোঁচট খাচ্ছিলাম। এবার উল্টোটা হয়েছে। হয়তো বল পায়ে ততটা ভালো ছিলাম না। কিন্তু দেখিয়েছি আমরা কতটা স্থিতিশীল হতে পারি।

এবার সময় এসেছে দুই দিকই একত্র করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার, ইনশাআল্লাহ।’ ২০০৩ সালের পর এই প্রথম ভারতের বিপক্ষে জয়ের উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠার উপলক্ষ পেল বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীরা। ২২ বছর আগের অনুভূতি ফিরিয়ে দিতে পারার আনন্দও অনুভব করছেন হামজা। তবে বাছাই পেরুতে না পারার আক্ষেপও আছে তার, ‘আমরা ১৮ কোটি মানুষকে খুশি করেছি। পৃথিবীর আর কোথাও এটা সম্ভব নয়। তাই এটি অবশ্যই আমার ক্যারিয়ারের সেরা সাফল্যের মধ্যে থাকবে।’

হামজা বলেন, ‘হ্যাঁ কষ্ট লাগে অবশ্যই বাছাই পেরুতে না পেরে। কিন্তু এটিও এক ধরনের ফাইনাল ছিল। ২২ বছর মানুষ অপেক্ষা করে আছে বড় ম্যাচ জেতার জন্য। এবার সেটাই হয়েছে। আমরা সবাই জানতাম-পারফরম্যান্স তো হচ্ছেই, এবার দরকার ফল। এবার হয়তো পারফরম্যান্সটা পুরোদমে হয়নি, কিন্তু ফল এসেছে। এখন মার্চে আবার নতুন করে তৈরি হব। দুটিকে একসঙ্গে মিলিয়ে আরও শক্ত দল হয়ে ফিরব ইনশাআল্লাহ।’
বাংলাদেশের জয়সূচক গোলটির কারিগর মিডফিল্ডার রাকিব হোসেন। ম্যাচের ১২ মিনিটে বাঁ প্রান্ত ধরে বল নিয়ে ছুটেন রাকিব হোসেন। তাকে আটকাতে মরিয়া ভারতের তিন ফুটবলার। কিন্তু পারেননি। বক্সের পাশ থেকে তার নিখুঁত পাস, ডান দিক থেকে দৌড়ে আসা শেখ মোরসালিন বলটা জালে ঠেলে দিয়েই রাকিবকে নিয়ে উদ্যাপনে মাতেন। তাতেই ২২ হাজার দর্শকের চিৎকারে প্রকম্পিত পুরো ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়াম। এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে ভারতকে হারানো সেই গোলের মুহূর্তটা চাইলেও ভুলতে পারবেন না রাকিব। কারণ, এটা তার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা পাস।

২০২০ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশের জার্সিতে অভিষেক রাকিবের। এর পর থেকে বহু জয়ের সাক্ষী হয়েছেন। জাতীয় দলের হয়ে ৪৯ ম্যাচে করেছেন ৬ গোল। পাশাপাশি ৫ গোলে সহায়তা। কিন্তু  ভারতের বিপক্ষে যে গোল বানিয়ে দিয়েছেন সেটার গুরুত্ব রাকিবের কাছে অনেক, ‘এই পাসটা আমার অনেক দিন মনে থাকবে। একটা গোল করার পর যতটা না ভালো লাগে; ঠিক ততটাই খুশি লেগেছে।’ রাকিবের কাছে হামজা সাধারণ একজন সতীর্থ নন, সত্যিকারের নেতাও, ‘হামজা শুধু আমাদের টিমমেট নন, তিনি নেতাও। তিনি সব সময় আমাদের অনুপ্রেরণা দেন। ভারত ম্যাচের আগেও সাহস জুগিয়েছেন। কেউ ভুল করলেও সাপোর্ট দেন।’
এদিকে ভারতীয় গণমাধ্যমে এই হারকে ‘লজ্জার’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ান ডার্বির পর ভারতের বেশকিছু গণমাধ্যম বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দ্য হিন্দু, এনডিটিভি, ফার্স্ট পোস্টসহ বেশিরভাগ মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোতে ভারতের হারকে লজ্জার হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *