বাজারে যেতে যেতে কেবলই আল্লাহ আল্লাহ জপ করি। খাঁটি কোনোকিছু বিক্রেতারা যাতে আমার কাছে বিক্রি না করে। খাঁটি কিছু খেয়ে এখন আর হজম করতে পারি না। ভালো কোনোকিছু খেলেই মল মবিলের মতো তরল হয়। সোজা বাংলায়– খাঁটি খাদ্য এখন পেটে অসুখের কারণ হয়। গিন্নিও নিষেধ করে ভালো কিছু কিনতে। ভেজালের দুনিয়ায় অসুস্থ স্বামী সেবার মন তারও অবশিষ্ট নাই। কোনো পণ্যের গায়ে খাঁটি, আসল লেখা দেখলে সেটা খুব আগ্রহ করে বিশ্বাসের সাথে কিনি। কেননা খুব ভালো করেই জানি, আদি, আসল, খাঁটি লিখে সেটায় খুব যত্ন করেই ভেজাল মেশানো হয়। বরং এগুলোতেই বেশি ভেজাল মিশ্রণ করা হয়।
ভেজাল খাবার খেতে খেতে পাকস্থলী মেনে নিয়েছে–এগুলোই নিয়তি। কাজেই ভেজালের সাথে একটুখানি খাঁটি কিছু পেলে খাঁটিকে সন্দেহ করে দেহকে সংকেত পাঠায়। পেটে ব্যথা হয়, পেটের ভেতর পুট পুট করে, মাথা ঘুরিয়ে বমন আসে এবং শেষ পর্যন্ত তরল ত্যাগে শরীর ক্লান্ত হয়। এজন্য আবার আসল ওষুধ খেলেও কাজ হবে না। ভেজাল ওষুধ খেলেই তবে শরীর ভালো হওয়ার ভান ধরবে।
আসল ওষুধ আবিষ্কার করা এখন যুদ্ধের চেয়েও কঠিন। কত কোম্পানি, কত নাম। বাঙালিকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য ইংরেজি ও বিদেশি ভাষায় নামই হাতিয়ার। খাবারে যত ভেজাল, শরীরের তত শান্তি। জিহ্বায় যেটা বেশি মজা লাগে, যেটা দেখতে রঙচঙে মনে হয় এবং যেটার সুবাস বেশি–ধরেই নিতে হবে ওসব ভেজাল। টেস্টিং সল্ট, ফুড কালার এবং রাসায়নিকের রসায়নেই সবকিছু পাল্টে গেছে।
মাছের চামড়া থেকে মানুষের শরীর–সবকিছুতেই রঙের বাহার। মাংসে সিসা, সবজিতে রাসায়নিক এবং বাতাসে বিষ–এসব ছেড়ে একদিন থাকলেই মানুষ বরং অসুস্থ হয়ে যাবে। বাঙালি আগে দুধটুকু চুকচুক করে খেতো, অথচ এখন নাকি দুধ বানাতে গরু লাগেই না। পানি আর রাসায়নিকেই সুন্দর ধবধবে সাদারঙের দুধ হয়ে যায়।
বিক্রেতার কাছে সবজি–ফল মাসের পর মাস কী করে টনটনা তা নিয়ে বে–আক্কলে গবেষণা করতে পারে! তরকারির দেহ ফুলাতে, সবজি ওজনে ভারী করতে টনিকের ব্যবহারে মানুষের টনক নড়ে না! এক সপ্তাহেই মুলা, করলা, কপি কিংবা কুমড়া ফুলেফেঁপে একাকার হয়ে যাবে! কলার সাইজ দেখলে ভয় ধরে! তরমুজের ভেতরেও খুব যত্ন করে রঙের খেলা জমে!
আগের জমানায় কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে খাঁটি পাকা পেঁপের সুনাম ছিল! কচি–কাঁচা পেঁপে পাকানোর যে তরিকা তথা কাগজের মোড়ামুড়ির আড়ালে যে একফোঁটা রাসায়নিক যত্ন করে দেওয়া হয়, তাতে পেট পাতলা না হয়ে উপায় আছে? এককালে ফরমালিন নিয়ে খুব সমালোচনা হতো! প্রশাসনের চাপে ফরমালিন বোধহয় হারিয়ে গেছে বাঙলার মাটি থেকে!
কিন্তু সে একই কাজ করতে এখন কোন নামে বাজারে জাদুর রস ঢুকেছে, তা বের করার দরকার নাই! যে জাতি ভেজালে অভ্যস্ত হয়ে গেছে তাদের সামনে আসল আনলে বরং সন্দেহ বাড়বেই! নকলে যাদের আস্থা, আসলে তাদের সংশয় থাকবে। মানুষ এমনভাবে স্রষ্টা–নবি, মা–স্ত্রীর নামে দিব্যি কেটে ভেজাল বিক্রি করে, তাতে মনে হয় ওরা অমরত্ব নিয়েই দুনিয়াতে এসেছে।
তেলে নাকি তেলবীজ নাই–ই! সব রাসায়নিক বিক্রিয়ায় উৎপাদিত বিষক্রিয়ার ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়া! যারা মুগডালের ভেজাল মেশায়, মুসুরিতে হলুদ লাগায়, চালে মোম গলায়–তারা কী খায়? দুধের সাথে বিশুদ্ধ পানি মিশিয়ে ওজন বাড়ালে এখন আর সত্যিই মাইন্ড করার সুযোগ নাই! কিন্তু বিশুদ্ধ পানিটাও তো মেশাচ্ছে না! নর্দমার পানিটাকেই ঘাটাচ্ছে!
ফুচকার টকে তেঁতুলের নাম তেঁতুল জানে না! মানুষের খাদ্যের পরে এবার মাছ, মুরগি, গরুর কিংবা পাখির খাবারের সাথেও ভেজালের কারবার! কুকুরের খাবারে যখন ভেজাল মেশানো হয় তখন গন্ধ শুঁকে ওরা টের পায়! অতঃপর কুকুরেরা মানুষকে কুকুর বলেই ডাকে!
যে কসমেটিকস ঘষেমেজে মানুষ একটু সুন্দর হতে চায় তাতেও ভেজাল মাখাচ্ছে মুখোশধারী ব্যবসায়ী! ওদের মনটাই যে কালো! অথচ নামাজে মসজিদের সামনের কাতারে সেজদা দিয়ে কপালে দাগ ফেলে দিচ্ছে, হজ ও ওমরাও হচ্ছে কিংবা নীতিকথাতেও– বাপরে বাপ! হলুদ–মরিচের গুঁড়ায় ইটের গুঁড়ো মেশানো থামছে না! এরপরেও মানুষের গড় আয়ু এত বেশি–আশ্চর্যজনক লাগে না?
খাদ্য খাচ্ছি নাকি বিষ–প্রশ্ন তোলাই যাচ্ছে না। ব্যবসায়ীরাই এখন মন্ত্রী–এমপি, কাতেব–কুতুব। মাছের ফুলকিতে তরতাজা রঙ, পশুর গোশ্তে গলদের শেষ নাই! মানুষের কারবার পশুদের পশুত্ব ছাপিয়ে গেছে সেই কবে! সবজিতে যে ভেজাল তাতে খাবার হাত না ধুয়ে খেলেও তারচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় না! মানুষ যাবে কই? কবরে! আসল ঠিকানা তা ওদিকেই! ভেজালকারীরা বরং উপকার করছে–আসল ঠিকানায় দ্রুত পৌঁছে দেওয়ার আমল করছে!