বর্ণমালার মাত্রা লাভ

বাংলা ভাষার পঞ্চাশটি বর্ণের গতিবিধি সন্দেহজনক! এদের আচার-আচরণ দিন দিন মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে শুরু করলো। পণ্ডিতদের কাছে অনেকেই এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিল। ব্যাকরণবিদেরা পড়লেন মহামুশকিলে। ভাষা লিখনের ওই সাংকেতিক চিহ্ন হলো বর্ণ। তারা যদি ভাষা লেখার কাজে মাত্রা হারিয়ে ফেলে তাহলে বাংলা বর্ণমালা বা বঙ্গলিপি তার সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলবে। ব্যাকরণবিদেরা চিন্তায় পড়লেন। তাঁরা ভাবলেন–বর্ণগুলোর মাত্রা নির্ধারণ করে দিলে কেমন হয়? বর্ণগুলোর মাত্রা ঠিক করে দিলে তারা আর মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারবে না। যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। বর্ণের মাত্রা নির্ধারণের বিষয়টা ব্যাকরণবিদরা চূড়ান্ত করে ফেললেন। 
খবরটা বর্ণদের কানে পৌঁছে গেলো। তাদের আর আনন্দের সীমা রইলো না। তারা মাত্রা পাবে। তারা আর মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে না। 
বর্ণদের মধ্যে আছে দুটো গোত্র। একটা স্বর, অন্যটা ব্যঞ্জন। স্বরবর্ণেরা সংখ্যায় এগারো। ব্যঞ্জনেরা তাদের তুলনায় সংখ্যায় অনেক বেশি। তারা সংখ্যায় ঊনচল্লিশ। স্বরবর্ণেরা সংখ্যায় কম হলে কী হবে তাদের শক্তি অনেক বেশি। তাদের নাম ধরে যে কেউ অনায়াসে ডাকতে পারে। নাম ধরে ডাকার বেলায় ব্যঞ্জনবর্ণগুলো অনেকটাই দুর্বল। তাদের নাম ধরে ডাকতে গেলে অন্য গোত্রের বর্ণের সাহায্য নিতে হয়।
বর্ণদের এই দুই গোষ্ঠীই তাদের মাত্রা লাভের খবর শুনলো। তারা একত্রে মিলিত হলো। কে, কতোটুকু মাত্রা পাবে এই নিয়ে তারা আলোচনা করতে লাগলো। এমন সময় সেখানে ‘চন্দ্রবিন্দু’ এসে হাজির হলো। চন্দ্রবিন্দু হলো ব্যঞ্জন গোত্রের পরাশ্রয়ী বা অযোগবাহী বর্ণ। চন্দ্রবিন্দু একটা খবর জানতে পেরেছে। সেই খবরটা তার জাত ভাইদের জানাতে সে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এসেছে। চন্দ্রবিন্দু বললো, ‘শোনো ভায়েরা, আমার স্থান যে সবার ওপরে তাতো তোমরা জানোই। আমি ওপরে থেকেই জানতে পেরেছি, ভাষাপণ্ডিতেরা আমাদের সবাইকে মাত্রা প্রদান করবেন না। সবাই আমরা পূর্ণ মাত্রাও পাবো না।’
–আমরা কে, কী মাত্রা পাবো এর কিছু কী তুমি জানতে পেরেছো চান মামা? চন্দ্রবিন্দুর কাছে জানতে চাইলো ‘বিসর্গ’।                                
‘আমি পুরোপুরি জানতে পারিনিরে দুঃখীরাম। শুধু জেনেছি–বত্রিশ বর্ণ পাবে পূর্ণমাত্রা, অর্ধমাত্রা পাবে আট বর্ণে, আর দশটি বর্ণকে কোনো মাত্রাই দেওয়া হবে না। আমি অন্ধকারে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থেকে পণ্ডিতদের কথা শুনছিলাম। ধরা পড়ার ভয়ে পুরোটা না শুনেই চলে এসেছি।’ বিসর্গের কথার উত্তর দিল চন্দ্রবিন্দু।
চন্দ্রবিন্দুর কথায় অন্য বর্ণেরা কিছুটা চিন্তিত হলো। তারা বলাবলি করতে লাগলো, কার ভাগ্যে পূর্ণমাত্রা জুটবে? কে কে পাবে অর্ধমাত্রা? আর মাত্রাহীন রয়ে যাবে কোন কোন হতভাগা ?    
ব্যাকরণবিদেরা পঞ্চাশটি বর্ণকে ডাকলেন। এখন জানানো হবে কে, কতটুকু মাত্রা পাবে। ব্যাকরণবিদ পাণিনি ‘মাহেশ ব্যাকরণ’ নামক গ্রন্থ থেকে সূত্র নিয়ে কয়েক হাজার বছর আগে যে ‘অষ্টাধ্যায়ী’ ব্যাকরণ গ্রন্থ লিখেছিলেন মূলত সেই গ্রন্থের আলোকেই আধুনিক যুগের পণ্ডিতেরা বর্ণগুলোর মাত্রা নির্ধারণ করলেন। বর্ণেরা কে, কোন মাত্রা পেয়েছে জনৈক বৈয়াকরণ তা ঘোষণা করলেন। তিনি বললেন-
শোনো শোনো বর্ণমালা, শোনো দিয়ে কান-
তোমরা কে, কোন মাত্রা পেলে শোনো সমাধান।
বত্রিশটি বর্ণ পেল পূর্ণমাত্রা ভাই,
আটটির অর্ধমাত্রা, দশটির কোনো মাত্রা নাই। 
‘খণ্ড ৎ’ বর্ণটি ঘোষক ব্যাকরণবিদের ঘোষণা খণ্ডন করে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, ‘আরে মশাই, আমরা এ খবর আগেই শুনেছি। আপনি এখন আমাদের বলুনতো–আমরা কে, কোন মাত্রা পেয়েছি? আমাদের আর তর সইছে না।’
ঘোষক ব্যাকরণবিদ কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললেন, আমি বিষয়টা তোমাদের জানাচ্ছিলামই। যাহোক, মাত্রার বিষয়টা তোমাদের এখন স্পষ্ট করে বলছি।  
পূর্ণমাত্রা পেলো যে বত্রিশ বর্ণ তারা হলো–অ, আ, ই, ঈ, উ, ঊ, ক, ঘ, চ, ছ, জ, ঝ, ট, ঠ, ড, ঢ, ত, দ, ন, ফ, ব, ভ, ম, য, র, ল, ষ, স, হ, ড়, ঢ়, য়। 
অর্ধমাত্রা পেলো যে আট বর্ণ,তারা হলো- ঋ, খ, গ, ণ, থ, ধ, প, শ। 
মাত্রা পায়নি যে দশ বর্ণ, তারা হলো– এ, ঐ, ও, ঔ, ঙ, ঞ, ৎ, ং, ঃ, ঁ।  
মাত্রা পেয়ে বেশি খুশি হলো পূর্ণমাত্রার বর্ণগুলো। অর্ধমাত্রার বর্ণরা কিছুটা কষ্ট পেলো। আর মাত্রাহীন বর্ণগুলো কী করলো? তারা সবাই মিলে হইচই শুরু করে দিল। তাদের হৈ-হুল্লোড় শুনে প্রধান বৈয়াকরণ ‘ধূলি ভরা দুটি লইয়া চরণ’ ছুটে এলেন। এসেই ধমক দিলেন মাত্রাহীন বর্ণদের। শেষে সব বর্ণের উদ্দেশে এক জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দিলেন তিনি। যার সারমর্ম হলো–মাত্রাহীন বর্ণ মাত্রা ছাড়াই সুন্দর। বরং এদের মাত্রা দিলেই শ্রীহীন দেখাবে। ‘এ’ এবং ‘ও’ এই দুটি বর্ণকে মাত্রা দেওয়া হলেতো তাদের শ্রী-চেহারাই পাল্টে যাবে। তাদের কেউই চিনবে না। আর অর্ধমাত্রাদের পূর্ণমাত্রা দিলেও দেখতে খারাপ লাগবে। আবার মাত্রা না দিলেও বিশ্রী দেখা যাবে। সুতরাং কারও প্রতি কোনো অবিচার করা হয়নি। তাই মন খারাপের কিছুই নেই। প্রধান ব্যাকরণবিদের কথায় বর্ণদের মনের দ্বন্দ্ব দূর হলো।
আমরা বর্ণগুলোর মাত্রা সম্পর্কে জানলাম। বর্ণগুলো লেখার ব্যাপারে আমরা কেউ যেন মাত্রা ছাড়িয়ে না যাই, সেদিকে লক্ষ রাখবো!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *