রাজনৈতিক অঙ্গনে নারীর অংশগ্রহণে প্রতিবন্ধকতা

গত চার দশকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্বে নারীর উপস্থিতি বিশ্বে অনন্য উদাহরণ হলেও, বাস্তবিক রাজনৈতিক কাঠামোয় নারীর অংশগ্রহণ নিয়ে দু’কথা বলার জায়গা আছে বৈকি! রাজনৈতিক কাঠামোয় নারীর অংশগ্রহণ এখনো পর্যন্ত সীমিতই বলা যায়। সামাজিক মানসিকতা, রাজনৈতিক দলগুলোর চিরায়ত দলীয় সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা ও নিরাপত্তাহীনতা সব মিলিয়ে আমাদের দেশের নারীরা এখনো কার্যকর রাজনৈতিক নেতৃত্বে পৌঁছাতে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছেন। এই লেখায় বাংলাদেশের নারীদের রাজনৈতিক অগ্রযাত্রার প্রধান বাধাসমূহ ও সেগুলো নিরসনের সম্ভাব্য করণীয় বিষয়ে খানিকটা আলোচনা করতে চাই।

গত জুলাই ২০২৪–এ রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে অবসান ঘটে দীর্ঘ চার দশকের রাষ্ট্রীয় তথা সংসদীয় নারী নেতৃত্বের। এর আগ পর্যন্ত; প্রধানমন্ত্রী, সংসদের স্পিকার, বিরোধী দলের নেতা এমন গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নারীর উপস্থিতি দেশের নারী–ক্ষমতায়নের প্রতীক হয়ে ছিল। কিন্তু এই দৃশ্যমান নেতৃত্ব নারীদের সামগ্রিক রাজনৈতিক অংশগ্রহণের বাস্তব চিত্রকে প্রতিফলিত করে না। তৃণমূল পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত নারীদের অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বের ক্ষেত্রে রয়েছে নানা কাঠামোগত ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা।

রাজনীতি এখনো অনেকের দৃষ্টিতে পুরুষদের ক্ষেত্র। সমাজে এখনো নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। অনেক পরিবার মেয়েদের রাজনীতিতে তথা রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে যোগ দিতে, রাজনৈতিক দলে নাম লেখাতে, মিছিলে যেতে মোদ্দাকথা সার্বিক অংশগ্রহণে নিরুৎসাহিত করে, কারণ এটি ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বা ‘অসম্মানজনক’ বলে বিবেচিত হয়। এই মানসিক প্রতিবন্ধকতাই নারীদের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশে বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে।

এদিকে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলে নারী সদস্যগণ মাঠপর্যায়ের কর্মী হিসেবে সক্রিয় থাকলেও, সিদ্ধান্ত গ্রহণের উচ্চপর্যায়ে তাদের উপস্থিতি নাই বললেই চলে। সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য হিসেবে অনেক নারী দায়িত্ব পেলেও, তাঁদের মনোনয়ন সাধারণত দলীয় পুরুষ নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল। ফলে তারা স্বাধীনভাবে দলীয় নীতি বা জনস্বার্থে ভূমিকা রাখতে পারেন না।

বলাবাহুল্য যে নির্বাচনী রাজনীতি বর্তমানে একটি ব্যয়সাপেক্ষ বিষয়। মনোনয়ন ফি, প্রচার, জনসংযোগ সব ক্ষেত্রেই অর্থের প্রয়োজন হয়। কিন্তু অধিকাংশ নারী প্রার্থী আর্থিকভাবে পুরুষ প্রতিদ্বন্দ্বী সমকক্ষ নন। নিজস্ব আয়ের উৎস না থাকায় তারা নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েন। ফলে রাজনৈতিক মাঠে তাদের উপস্থিতি টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।

আবার রাজনৈতিক অঙ্গনে তথা নানান কর্মসূচিতে, মাঠ পর্যায়ের কাজে থাকা নিয়ে নারীরা প্রায়ই শারীরিক, মৌখিক এবং অনলাইন সহিংসতার শিকার হন। নির্বাচনী প্রচারণা বা সভা–সমাবেশে নারী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে হুমকি, কুৎসা ও মানহানিকর মন্তব্য এখন নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনা। এই বাস্তবতা নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণে নিরুৎসাহিত করে এবং পরিবারগুলোও নিরাপত্তার কারণে তাদের রাজনীতি থেকে দূরে রাখে।

সংরক্ষিত আসন ব্যবস্থা নারীর সংখ্যাগত উপস্থিতি বাড়ালেও, বাস্তব ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে এটি অনেক সময় অকার্যকর। কারণ, সংরক্ষিত আসনের সদস্যরা দলীয় মনোনয়নের ওপর নির্ভরশীল, সাধারণ ভোটে নির্বাচিত নেতাদের রাজনৈতিকভাবে প্রভাব বিস্তারি অবস্থান থেকে তারা পিছিয়েই থাকেন। ফলে তাঁরা নীতি নির্ধারণে স্বাধীন ভূমিকা রাখতে পারেন না।

দক্ষতা ও নেতৃত্ব বিকাশের ঘাটতি এখানে আরেকটি বড় অন্তরায়। রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষণ, নীতি–জ্ঞান ও দক্ষতা। কিন্তু নারীদের জন্য রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ ও নেতৃত্ব বিকাশের উদ্যোগ প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চোখেই পড়ে না। বা থাকলেও তা খুব সীমিত। ফলে তাঁরা সংসদীয় বিতর্ক, দলীয় কৌশল বা প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় পুরুষদের মতো দৃঢ় ভূমিকা রাখতে পারেন না।

এছাড়াও রয়েছে গণমাধ্যম ও সামাজিক পর্যায়ের মোটদাগের দৃষ্টিভঙ্গি। গণমাধ্যমে নারী রাজনীতিকদের উপস্থাপনা প্রায়ই পক্ষপাতদুষ্ট হয়। তাঁদের রাজনৈতিক কর্মের চেয়ে তাদের পোশাক, ব্যক্তিজীবন বা সামাজিক আচরণ নিয়ে আলোচনা হয় বেশি। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেও নারী রাজনীতিকরা সাইবার বুলিং ও অপপ্রচার, এমনকী স্লাট শেইমিংয়েরও সম্মুখীন হন, যা তাঁদের আত্মবিশ্বাসে আঘাত হানে।

এহেন পরিস্থিতিতে নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে রাজনৈতিক দলসমূহের অভ্যন্তরে নারী সদস্যদের অধিক হারে অংশগ্রহণ, নির্ধারিত সুবিধাদির কার্যকর বাস্তবায়ন ও নারী নেতৃত্বে প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নারীদের জন্য সহায়ক তহবিল ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলাও প্রয়োজন। পাশাপাশি, সাইবার ও রাজনৈতিক সহিংসতা প্রতিরোধে কঠোর আইন প্রয়োগের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। পরিবার ও শিক্ষা ব্যবস্থায় নেতৃত্ব, সমতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ জোরদার করলে দীর্ঘমেয়াদে নারী রাজনীতিকদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি হবে। মাঠ পর্যায়ে নারীদের রাজনৈতিক অঙ্গনে অংশগ্রহণের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরির আশ্বাস, উদাহরণমূলক পরিবেশ তৈরি, প্রণোদনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

বাংলাদেশের নারীরা খেলাধুলা, বিজ্ঞান, ব্যবসায়, ক্ষুদ্র উদ্যোগ, শিল্প–সাহিত্য এবং রাষ্ট্রক্ষমতা ইত্যাদিতে ইতোমধ্যেই প্রমাণ করেছেন যে সুযোগ পেলে তাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের নেতৃত্বে দক্ষভাবে ভূমিকা রাখতে পারেন। কিন্তু নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণকে যদি কেবল ‘‘ “শো–পিস’’ বা “প্রতীকী উপস্থিতি” বা ‘‘প্রতীকী অংশগ্রহণ’’ –এ সীমাবদ্ধ রাখা হয়, তবে গণতন্ত্রের কৌম লক্ষ্য কখনো অর্জিত হবে না। একটি সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়তে হলে রাজনীতির প্রতিটি স্তরে নারীকে অংশীদার নয়, নেতৃত্বের অংশ হিসেবে দেখতে হবে। তাহলেই বাংলাদেশে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হবে বাস্তব ও টেকসই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *