নাগরিক কোলাহলের কবি

তানযীর তুহীনের গান মানেই ব্যতিক্রমী কথা-সুর, অভিনব আয়োজন। যখনই এই শিল্পীর গাওয়া কোনো গানের প্রসঙ্গ আসে, তখন কম-বেশি সবার মুখে এই কথাই শোনা যায়। একইভাবে সমাজমাধ্যমে প্রতিনিয়ত অনুরাগীরা লিখে চলেছেন মুগ্ধতার বয়ান। এই মুহূর্তে ‘ক্যাফে’ গানের সূত্র ধরে রীতিমতো চলছে তানযীর তুহীনবন্দনা। গীতিকথা লেখা, সুর করা আর দরাজ কণ্ঠে গেয়ে যাওয়া গানগুলো নিয়ে শিল্পীকে আমরা ‘নাগরিক কোলাহলের কবি’ বলি, তাঁর আরেকটি ব্যতিক্রমী উপস্থাপনা নিয়ে কথা হবে, শোনা যাবে শোরগোল– এটিই স্বাভাবিক। সেই কারণে অনলাইনভিত্তিক সংগীতানুষ্ঠান ‘কোক স্টুডিও বাংলা’য় গাওয়া তাঁর ফিউশনধর্মী আয়োজন ‘ক্যাফে’ নিয়ে শুরু হয়েছিল আমাদের আলোচনা পর্ব। যে গানটি প্রকাশের পর থেকে শ্রোতামনে অনুরণন তুলে যাচ্ছে, তার সৃষ্টি নিয়ে ছিল প্রথম প্রশ্ন। 

কীভাবে ফিউশনধর্মী এই আয়োজন সূচনা, তা জানতে চাইলে তুহীন বলেন, ‘ক্যাফে’র গল্পটা এরকম–হঠাৎ একদিন ফোন এলো অর্ণবের কাছ থেকে। কেমন আছি, কী করছি, এইসব সৌজন্য কথা পাশ কাটিয়ে সরাসরি বললো, ‘একটা গান করতে চাই’। আমি সোজাসাপ্টা বলে দিলাম, ‘ঠিক আছে করব।’ ব্যস, এই কথার পর দিনক্ষণ ঠিক হবে কবে গান করার বিষয়টি নিয়ে একসঙ্গে বসা যায়। এরপর নির্দিষ্ট দিনে অর্ণবের সঙ্গে আলোচনায় বসলাম। এদিন আমাদের সঙ্গে ছিলেন শুভেন্দু। দুজনে পরিকল্পনার কথা জানালেন।

 বললেন, এবার আমরা ‘ক্যাফে’ গানটা করতে চাই। জানাতে চাইলাম, কীভাবে করা হবে। তখন ওরা জানালো, অরিজিন স্প্যানিশ ‘ক্যাফে’ গানটির কিছু অংশ থাকবে ‘কোক স্টুডিও বাংলা’র এবারের আয়োজন। সঙ্গে থাকবেন মাহীনের ঘোড়াগুলি ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের ছেলে গৌরব চট্টোপাধ্যায়, যিনি গাবু নামে পরিচিত; যে এখন লক্ষ্মীছাড়া ব্যান্ডের ভোকাল ও ড্রামার। এসব জানার পর আমিও কাজটি করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করিনি। মুহূর্তের মধ্যে বলে দিয়েছি, করি চলো। এরপরই শুরু ‘ক্যাফে’র আয়োজন। এরপর যা হয়েছে সেটি তো এখন দর্শক-শ্রোতার সামনে। এই হলো তানযীর তুহীনের নতুন গানের গল্প। যে গানটি এখন রীতিমতো আলোড়ন তুলে যাচ্ছে সংগীতপ্রেমীদের মাঝে।

 ‘ক্যাফে’ কোক স্টুডিও বাংলার তৃতীয় সিজনের সপ্তম গান। শুভেন্দু দাস শুভর সংগীতায়োজনে, এই গানে স্থান পেয়েছে এফো-কিউবান জ্যাজ, লাতিন সালসা ও বাংলা পঙ্ক্তি। একাধিক সংস্কৃতির মিশ্রণে তারা সবাই মিলে সৃষ্টি করেছেন প্রাণবন্ত এক সংগীত, যেখানে উদযাপিত হয়েছে ঐতিহ্য, আবেগ ও বৈশ্বিক সুরের মেলবন্ধন; যার সুবাদে শিরোনামহীন ব্যান্ডের সাবেক সদস্য এবং বর্তমান আভাস ব্যান্ডের শিল্পী তানযীর তুহীনকে আবারও নতুনভাবে আবিষ্কার করছেন সংগীতপ্রেমীরা। 

শুরু থেকে গায়কিতে নিজস্বয়তা ধরে রেখে ব্যতিক্রমী উপস্থাপনা তুলে ধরে আসছেন তানযীর তুহীন। ক্যারিয়ারের প্রথম ভাগে ব্যান্ড শিরোনামহীনের সঙ্গে ছিল তাঁর পরিক্রমা। এখন ব্যান্ড আভাসকে নিয়ে পথ পাড়ি দিচ্ছেন তিনি। এককভাবেও বেশ কিছু গান গেয়েছেন। প্লেব্যাক করেছেন নাটক ও সিনেমার গানে। এভাবেই গানের ভুবনে পাড়ি দিয়েছেন দুই দশকের পথ। এই দীর্ঘ পথপরিক্রমার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে জানতে চাইলে তুহীন বলেন, ‘গান গেয়ে আসলে কী পাওয়া উচিত, কী পাইনি তা নিয়ে সত্যি ভাবিনি। মাধ্যম যেটিই হোক; মানুষ গান শুনুক, গানগুলো বেঁচে থাকুক–এটাই আমার চাওয়া।’ 

নিজের গান নিয়ে এমনই প্রত্যাশার কথা শোনালেন নন্দিত এই কণ্ঠশিল্পী। যে কথায় স্পষ্ট, খ্যাতি বা অর্থের মোহে গান করেন না তিনি। সৃষ্টির উপস্থাপনাই তাঁর কাছে মুখ্য। তাহলে কী নির্দিষ্ট শ্রেণির শ্রোতার কথা ভেবে সংগীত সৃষ্টি করে যেতে চান? এর জবাবে তুহীন বলেন, ‘এভাবে কখনও ভাবি না, বরং সবসময় চাই, মনের গহীন থেকে তুলে আনা অনুভূতি, দৃশ্যমান বাস্তবতা, জীবনের অনুষঙ্গ–এমন অনেক কিছু গানের বিষয় হিসেবে বেছে নিতে। কারণ আমি বিশ্বাস করি, সময়ের সঙ্গে মানুষের শিক্ষা-দীক্ষা, ভাবনার বদল ঘটবে। সস্তা জনপ্রিয় উপকরণ থেকে সরে এসে মানুষ নিখাদ জিনিস বেছে নেওয়া শুরু করবে।’
 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *