৩০ পেরোনো নারীর হাসি, ভালোবাসা ও আত্মমর্যাদার গল্প

সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলাচ্ছে সমাজ, পুনঃসংজ্ঞায়িত হচ্ছে ভালোবাসা আর সম্পর্কের ধারণা।  আশ্চর্যের বিষয় হলো, ভারতীয় উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীর জীবনে ‘বিয়ে’ এখনও এক অনিবার্য। বয়স যখন তিরিশের কোটা পেরোয়, তখন চারপাশের আত্মীয়-পরিজন, প্রতিবেশী–এমনকি অফিসের সহকর্মীরাও যেন এক অদৃশ্য ঘণ্টা বাজাতে শুরু করে ‘এখনও বিয়ে করো নাই?’ এই সামাজিক বাস্তবতাকে মজাদার, হৃদয়গ্রাহী এবং অত্যন্ত সমসাময়িক এক দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে ধরেছে বলিউডের নতুন সিনেমা ‘সিঙ্গেল সালমা’। বলা যায় এটি শুধু একটি রোমান্টিক কমেডি নয়, বরং একজন আধুনিক নারীর আত্মানুসন্ধান ও আত্মনির্ধারণের গল্প।

গল্পের সূত্রপাত লখনৌয়ের সেই সরু গলি, পুরোনো মিনার আর নবাবী শহর থেকে। এখানেই বাস করেন সিঙ্গেল সালমা সিনেমার অন্যতম প্রধান চরিত্র সালমা রিজভি (হুমা কুরেশি)। তিনি শুধু একজন ‘সিঙ্গেল’ নারী নন; তিনি একজন বুদ্ধিমতী, স্বাবলম্বী, আত্মবিশ্বাসী এক মানুষ। তিনি চাকরি করেন, সংসার সামলান এবং সমাজের কাছাকাছি মানুষদের অযাচিত মন্তব্যের জবাব দিতে তিনি পিছপা হন না। তবুও, তাঁর সম্পূর্ণ জীবনের ওপর চেপে বসে থাকে একটি একক প্রশ্ন ‘তুমি এখনও বিয়ে করনি কেন?’ কিন্তু সালমা তাঁর জীবনকে কোনো শপিং মলের ডিসকাউন্টের পণ্য হিসেবে দেখেন না, যেখানে একটি নির্দিষ্ট বয়স পর ‘বিক্রির সময় শেষ’ লেখা পোস্টার টাঙিয়ে দেওয়া হবে। তাঁর বিশ্বাস, জীবন হলো নিজের শর্তে, নিজের গতিতে উপভোগ করার এক সুযোগ। তবে, এই দৃঢ়তাকে পরিবারের চোখে, সমাজের দৃষ্টিতে এবং কখনও কখনও প্রিয়জনদের কাছেও সে এক রহস্য হিসেবে দেখা দেয়। সালমা প্রেমে পড়তে জানেন। সেই প্রেমে নিজের সত্তাকে বিসর্জন দিতে জানেন না।

এই জটিল পরিস্থিতিতে সালমার জীবনে আসেন দুজন ভিন্নমনা পুরুষ। একজনের নাম সিকান্দার (শ্রেয়াস তালপাড়ে); যিনি শহরের চেনা-পরিচিত একজন মানুষ। বয়সে একটু বড় হলেও তিনি প্রাণবন্ত, হাসিখুশি এবং সালমার প্রতি একেবারে আত্মসমর্পিত। অন্যজন মিট (সানি সিংহ)। লন্ডনে পড়াশোনা ও কাজ করা এক আধুনিক যুবক, যিনি ভালোবাসায় স্বাধীনতা চান, কিন্তু কোনো দীর্ঘমেয়াদি কমিটমেন্টের ব্যাপারে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত। দুজনই সালমাকে দারুণ ভালোবাসেন। দুজনই তাঁর মন জয় করতে চান। এখানেই গল্পের মোড় নেয়। 

প্রশ্নটি এই নয় যে সালমা ‘কাকে’ বেছে নেবেন। প্রশ্ন হলো, সালমা কি আদৌ এই ‘কাউকে বেছে নেওয়ার’ খেলায় অংশ নেবেন? নাকি তিনি নিজেকেই বেছে নেবেন—একজন স্বাধীন, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নারী হিসেবে নিজের শর্তে বেঁচে থাকার সাহসিক সিদ্ধান্তটি? এই জটিল ও সংবেদনশীল বিষয়টিকে মজাদার, মানবিক ও বাস্তবসম্মত দৃষ্টিকোণ থেকে ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচালক নচিকেত সামন্ত; যিনি তাঁর আগের কাজগুলোর মাধ্যমে ইতোমধ্যে একজন সূক্ষ্ম হাস্যরসবোধসম্পন্ন নির্মাতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। 

তিনি এই সিনেমা প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি একজন আধুনিক ভারতীয় নারীর গল্প বলতে চেয়েছি, যে নিজের পথে হাঁটে। তবে গল্পটি যেন ভারী বা উদ্দেশ্যমূলক না হয়ে ওঠে, সেদিকে খেয়াল রেখেছি। হাসি আর মজার মধ্য দিয়ে আমি বলতে চেয়েছি, একজন নারীকে তাঁর নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার দেওয়াটা কতটা জরুরি।’

অভিনেত্রী হুমা কুরেশি সালমা চরিত্রটিকে তাঁর নিজের জীবনেরই একটি অংশ বলে মনে করেন। এই চরিত্রে অভিনয়কে তিনি শুধু একটি পেশাগত দায়িত্বই মনে করেননি, বরং এক ধরনের অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ।

তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘সিঙ্গেল সালমা আমার জন্যে শুধু একটি সিনেমা নয়, এটি এক ধরনের অনুভূতি। সালমা চরিত্রটি খুবই বাস্তব, কিছুটা এলোমেলো, কিন্তু সে নিঃস্বার্থভাবে নিজের সুখ খুঁজে বেড়ায়। সে সমাজের গৎবাঁধা সংজ্ঞাকে মেনে নিতে রাজি নয়। এই সাহসটাই আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছে। আমি আশা করি, প্রতিটি নারী এই সিনেমায় নিজের জীবনেরই কোনো না কোনো গল্প খুঁজে পাবেন।’ 

সিনেমাটির দৃশ্যধারণ হয়েছে লখনৌ এবং লন্ডন—এই দুই ভিন্ন জগতে। লখনৌয়ের ঐতিহ্যবাহী অলিগলি, দোতলা পুরোনো বাড়ি, আতর ও কাবাবের সুবাসে ভরা হাটবাজারের পাশাপাশি দেখা মিলবে লন্ডনের ঝলমলে ও আধুনিক রাস্তার। নির্মাতা খুব নিপুণভাবে এই দুই সংস্কৃতির মধ্যে টানাপোড়েন এবং মিলনকে ফুটিয়ে তুলেছেন। এছাড়াও, চলচ্চিত্রের সংগীতও দর্শকদের হৃদয় ছুঁয়ে যাবে বলে আশা করছেন নির্মাতা। কারণ এতে রয়েছে আধুনিক পপসংগীত এবং সুরেলা কাওয়ালির এক মনোমুগ্ধকর মিশ্রণ, যা গল্পের আবেগকে আরও গভীর ও বহুমাত্রিক করে তুলবে।

সিনেমাটির টিজার, ট্রেলার আর পোস্টার প্রকাশের পর থেকে এটি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে শুরু হয়েছে জোরালো আলোচনা। পোস্টারে দেখা গেছে একটি অত্যন্ত মজাদার ও প্রতীকী দৃশ্য—একই রাতে দুই পক্ষের সাজানো বরযাত্রী দল, দুই মঞ্চ, আর ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে সালমা। এই একটি ছবিই যেন গল্প বলার জন্য যথেষ্ট। অনেক দর্শকই মন্তব্য করেছেন, ‘এটাই হতে যাচ্ছে বলিউডের পরবর্তী বড় উইমেন-সেন্ট্রিক হিট সিনেমা।’
সহজভাবে বলতে গেলে, ‘সিঙ্গেল সালমা’ শুধু একটি হাস্যরসের সিনেমা নয়। এটি ভারতীয় সমাজে নারীর স্বাধীনতা, তাঁর মতামত এবং আত্মমর্যাদা নিয়ে শুরু হওয়া এক নতুন সংলাপের সূচনা।

সিনেমাটি দৃঢ়তার সঙ্গে দেখায় যে ‘বিয়ে’ই জীবনের একমাত্র সুখ নয়, আর ‘সম্পর্ক’ই একমাত্র নিরাপত্তার জায়গা নয়। বরং সত্যিকারের স্বাধীনতা ও শান্তি আসে তখনই, যখন একজন নারী নিজের জীবন সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নিজের হাতে রাখেন। ইতোমধ্যে সিনেমাটির ট্রেলার ইউটিউবে মিলিয়ন ভিউ অতিক্রম করেছে, আর দর্শকদের প্রত্যাশা এখন আকাশছোঁয়া। হাস্যরস, আবেগ, সমাজের তীক্ষ্ণ বাস্তবতা ও এক আত্মবিশ্বাসী নারীর জয়যাত্রা—সবকিছু মিলিয়ে ‘সিঙ্গেল সালমা’ হতে যাচ্ছে চলতি বছরের সবচেয়ে প্রাণবন্ত, প্রাসঙ্গিক ও আলোচিত রোমান্টিক কমেডি। শেষ পর্যন্ত কে পাল্টাবে সালমার ‘রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস’ সিকান্দার, মিট, নাকি সালমা নিজেই? উত্তর জানা যাবে আগামীকাল। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *