ফরিদপুরের তিনটি উপজেলা ও পৌর শাখায় সম্প্রতি ঘোষিত বিএনপির নতুন কমিটিগুলো ঘিরে শুরু হয়েছে তীব্র বিতর্ক ও তোলপাড়। ঘোষিত কমিটিগুলোতে আওয়ামী লীগের পদধারী অন্তত ১৫ জন নেতা এবং দলটির অঙ্গসংগঠনের আরও ১২ জন নেতাকর্মী স্থান পেয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এমনকি আলোচিত সাবেক ডিবি প্রধান হারুন-অর-রশিদের এক সময়ের ক্যাশিয়ারও বিএনপির পদ পেয়েছেন। তালিকা প্রকাশের পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা ও কটাক্ষ চলছে। স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপির ত্যাগী নেতাকর্মীরা এই কমিটির বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং মাঠে নেমে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করছেন।
আলফাডাঙ্গা উপজেলা বিএনপির কমিটিতে একাধিক আওয়ামী লীগ নেতার নাম পাওয়া গেছে। উপজেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক মিয়া আসাদুজ্জামান (আসাদ মাস্টার) বিএনপির সহসভাপতি হয়েছেন। তিনি ২০২১ সালে নৌকা প্রতীকে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য আবদুল ওহাব পান্নু হয়েছেন বিএনপির সহসভাপতি, উপজেলা কৃষক লীগের সহসভাপতি মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান (মাসুদ মাস্টার) পেয়েছেন একই পদ। গত জাতীয় নির্বাচনে নৌকার পক্ষে প্রচার চালানো মনিরুজ্জামান মনির এখন বিএনপির সহসাধারণ সম্পাদক। এছাড়া আলফাডাঙ্গা যুবলীগের প্রচার সম্পাদক জাকার মেম্বারকে করা হয়েছে বিএনপির সহসমবায় সম্পাদক এবং গোপালপুর ইউনিয়ন কৃষক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ওহিদ শিকদার মেম্বারকে দেওয়া হয়েছে সহসাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব।
আলফাডাঙ্গা পৌর বিএনপির ১০১ সদস্যের কমিটিতেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত নেতাদের নাম পাওয়া গেছে। জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য কামরুজ্জামান কদর হয়েছেন পৌর বিএনপির প্রচার সম্পাদক। এছাড়া ডিএমপির সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার শ্যালক নুরুল ইসলাম লিটনকে উপজেলা বিএনপির সদস্য করা হয়েছে। বোয়ালমারী উপজেলা বিএনপির কমিটিতেও বিতর্কিত নাম পাওয়া গেছে। সেখানে আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী আবদুর রহমানের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি অমিত সাহাকে করা হয়েছে উপজেলা বিএনপির কোষাধ্যক্ষ। দাদপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলা বিশ্বাস, যুবলীগের সহসভাপতি সাইফুল ইসলাম বকুল এবং সাবেক ডিবি প্রধান হারুন-অর-রশিদের ক্যাশিয়ার মিজানুর রহমান সোনা মিয়াও বিএনপির বিভিন্ন পদে স্থান পেয়েছেন।
এছাড়া উপজেলা শ্রমিক লীগের সহসভাপতি হরেন কুমার কৃষ্ণ হয়েছেন পৌর বিএনপির সদস্য, সাতৈর ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সদস্য গোপাল সাহাকে করা হয়েছে উপজেলা বিএনপির সহ-কোষাধ্যক্ষ। মধুখালী উপজেলা বিএনপির কমিটিতে মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মাহমুদা বেগম কৃকের ঘনিষ্ঠ নাজমা সুলতানা, যিনি একসময় আওয়ামী লীগ মনোনীত কাউন্সিলর ছিলেন, তাকে করা হয়েছে মহিলাবিষয়ক সম্পাদক। আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মী হিসেবে পরিচিত মিলন মোল্লা, রায়হান মোল্লা, মিরাজুল ইসলাম মিল্টন ও আনোয়ার হোসেনও নতুন কমিটিতে বিভিন্ন পদে স্থান পেয়েছেন।
এই বিতর্কিত কমিটি ঘোষণার পর ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন বিএনপির ত্যাগী ও মাঠের নেতাকর্মীরা। তারা অভিযোগ করেছেন, যারা বছরের পর বছর দলীয় নির্যাতন সহ্য করে সংগঠনের পাশে ছিলেন, তারাই এবার পদবঞ্চিত হয়েছেন। ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ সমাবেশ, মশাল মিছিলসহ নানা কর্মসূচি পালন করছেন। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে জেলা বিএনপির সদস্য সচিব এ কে কিবরিয়া স্বপন জানান, “সেন্ট্রাল থেকে ফরওয়ার্ড করা কমিটি যাচাইয়ের সময় পাওয়া যায়নি। তবে যদি প্রমাণ পাওয়া যায় কেউ আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত, তাকে দল থেকে তাৎক্ষণিকভাবে অব্যাহতি দেওয়া হবে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘটনাটি বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতার একটি স্পষ্ট উদাহরণ। যাচাই-বাছাইয়ের অভাবে আওয়ামী লীগের সক্রিয় নেতাদের বিএনপির পদে অন্তর্ভুক্তি শুধু বিভ্রান্তি নয়, দলের ভেতর গভীর অসন্তোষও তৈরি করেছে। ত্যাগী নেতাদের বঞ্চনা ও বিতর্কিত ব্যক্তিদের পদপ্রাপ্তি বিএনপির অভ্যন্তরীণ বিভাজনকে আরও তীব্র করে তুলতে পারে। ফরিদপুর বিএনপির এই নতুন কমিটি এখন স্থানীয় রাজনীতির অন্যতম আলোচিত ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।