স্বাধীন, গ্রহণযোগ্য ও সমন্বিত সংস্কার বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলো গড়িমসি করলে তার দায়ভার তাদেরকেই নিতে হবে—এমন মন্তব্য করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)–এর সম্পাদক এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার।
তিনি বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলো যদি শুধু ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়ে দায়িত্ব শেষ করে, বাস্তবায়নের দিকে না যায়, তাহলে তার মাশুল শুধু রাজনীতিকরা নয়, দেশের সাধারণ নাগরিকদেরও দিতে হতে পারে—যা কাম্য নয়।”
মঙ্গলবার (২৭ আগস্ট) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সুজন আয়োজিত ‘প্রস্তাবিত জুলাই জাতীয় সনদ ও নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক নাগরিক সংলাপে তিনি এসব কথা বলেন।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “জুলাই সনদ কেবল প্রণয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না, এর বাস্তবায়নই সার্থকতা নিশ্চিত করবে। এজন্য সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং রাজনৈতিক দল—তিন পক্ষেরই দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রয়োজন।”
তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে এবং জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের শহীদদের আত্মত্যাগ যাতে বৃথা না যায়, সে জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
এছাড়া নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবিত সংস্কারগুলো কেন বাস্তবায়ন হচ্ছে না, সে বিষয়েও কমিশনের সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যার প্রয়োজন বলে মত দেন সুজন সম্পাদক।
গণভোট ও বাস্তবায়নের পথ
সংলাপে অংশ নিয়ে সাবেক মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বলেন, মৌলিক অধিকারের নতুন ধারাগুলো বাস্তবায়নে বাজেট ও সম্পদের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সনদ বাস্তবায়নের জন্য গণভোট বা প্রোক্লেমেশনের মাধ্যমে পরবর্তী সংসদে পাস করার পরামর্শ দেন।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য গঠন) মনির হায়দার জানান, সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব প্রসঙ্গে ঐকমত্য গঠন কমিশন পাঁচবার প্রস্তাব দিলেও রাজনৈতিক দলগুলো কোনোবারই একমত হয়নি। তিনি বলেন, “এখন অনেকেই কমিশনকে দোষ দিচ্ছেন, কিন্তু বারবার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সমর্থন পাওয়া যায়নি।”
নাগরিকদের মালিকানা ও বাস্তব জটিলতা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ মোহাম্মদ সাহান বলেন, “যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় আসুক, জুলাই সনদ তাদের স্বৈরাচারী আচরণ ঠেকাতে কার্যকর কোনো বড় বাধা সৃষ্টি করবে না।” তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো নোট অব ডিসেন্টের অবস্থান না ছাড়লে সনদ অর্থবহ পরিবর্তন আনবে না।
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের গবেষক মির্জা হাসান বলেন, “নাগরিকেরা তত্ত্বগতভাবে রাষ্ট্রের মালিক হলেও, বাস্তবে তা প্রয়োগ হয় না। সংস্কার কার্যক্রমও হচ্ছে ‘যতটুকু সম্ভব’—এই দৃষ্টিভঙ্গিতে।”
শহীদ পরিবারের উদ্বেগ
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নিহত মাহমুদুর রহমান সৈকতের বোন সাবরিনা আফরোজ বলেন, “আমার ভাইয়ের বিচার চলছে ঠিকই, কিন্তু আমরা আজও জানি না কে গুলি করেছিল। অন্য শহীদ পরিবারেরাও একই অবস্থায়।” তিনি বিচার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান।
মূল প্রবন্ধে প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি
সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুজনের জাতীয় কমিটির সদস্য একরাম হোসেন। তিনি বলেন, “জুলাই জাতীয় সনদের বিভিন্ন সংস্কারের মধ্যে রয়েছে—প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ১০ বছরে সীমিত করা, সংসদের উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা, অনুপাতিক পদ্ধতিতে সদস্য নির্বাচন, সুপ্রিম কোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংশোধন এবং সংসদীয় কমিটির নেতৃত্ব বিরোধী দলের হাতে দেওয়া।”
তবে তিনি হতাশা প্রকাশ করে বলেন, “নারীর যথাযথ প্রতিনিধিত্ব ও এনসিসির মাধ্যমে সাংবিধানিক নিয়োগ—এ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি।”
তিনি আরও বলেন, “নোট অব ডিসেন্ট দেওয়ার অর্থ এই নয় যে, তা সব সময় ধরে রাখা উচিত। ১৯৭২ সালে গণপরিষদে অনেক বিতর্কিত বিষয়েও শেষ পর্যন্ত ঐকমত্যে পৌঁছানো হয়েছিল—সেই উদাহরণ অনুসরণ করা দরকার।”
সংলাপের সভাপতি ছিলেন সুজনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন এবং সঞ্চালনায় ছিলেন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন আইইউটি শিক্ষক আবদুল আজিজ, সুজনের নির্বাহী সদস্য মুসবাহ আলীম, গবেষক মির্জা হাসান, অধ্যাপক আসিফ মোহাম্মদ সাহান এবং অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিরা।