নতুন প্রতিভার খোঁজে

রাজধানীর তেজগাঁওয়ে দীপ্ত টিভির কার্যালয়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর গড়াল। প্রবেশদ্বার থেকে অনুষ্ঠান–সংশ্লিষ্ট একজন নিয়ে গেলেন স্টুডিওতে। চলছে দৃশ্যধারণ। বিচারকের আসনে তখন ছিলেন প্রতিযোগিতার তিন বিচারক অভিনয়শিল্পী, নির্দেশক তারিক আনাম খান, পরিচালক শিহাব শাহীন ও অভিনেত্রী রাফিয়াত রশিদ মিথিলা। অতিথি বিচারক নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী। একটি পরিবেশনা শেষ হলে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছিলেন তাঁরা। এরই মাঝেই শুরু হয় মধ্যাহ্নভোজের বিরতি; সুযোগ মেলে বিচারকদের সঙ্গে কথা বলার।

কয়েক বছর ধরে ঢাকার রিয়েলিটি শো কিছুটা জৌলুশ হারিয়েছে। দীপ্তর এ আয়োজন আশার আলো দেখাচ্ছে বলে মনে করছেন বিচারকেরা। বর্তমান সময়ের অন্যতম ব্যস্ত নির্মাতা শিহাব শাহীন। চলতি ঈদে মুক্তি পেয়েছে তাঁর পরিচালনায় সিনেমা ‘দাগি’ ও ওয়েব সিরিজ ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন ২’। ‘দীপ্ত স্টার হান্ট’–এর সেরা ৪০ প্রতিযোগীকে নিয়ে শুরু হয়েছিল তাঁর বিচারকার্য। এখন তা সেরা দশে পৌঁছেছে। এ তিন মাসের জার্নিকে তিনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?—এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, এমন প্রতিযোগিতার আরও প্রয়োজন। তাহলে ইন্ডাস্ট্রি যেমন নবাগত অভিনেতাদের পাবে, তাদের দেখে আরও অনেকে উৎসাহ বোধ করবেন।

শিহাব শাহীন বলেন, ‘প্রথম দিকে কিছুটা হতাশ ছিলাম, কেমন হচ্ছে, কাদের আনল, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওরা যেভাবে নিজেদের মধ্যে পরিবর্তনটা এনেছে, যেভাবে এরা খোলস ছেড়ে বেরিয়েছে, এর জন্য দীপ্ত টিভির প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত সবাই ধন্যবাদ পাবেন। ওদের যেভাবে গ্রুমিং করানো হয়েছে, তা প্রশংসার জায়গা রাখে। এখন তারা অনেক পরিণত, তাদের ভেতর ভালো করার ক্ষুধা দেখতে পাচ্ছি। ওদের মাঝে সম্ভাবনা দেখছি।’এ ধরনের আয়োজনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে শিহাব শাহীন বলেন, ‘এটা খুবই দরকার। এটা কোনোভাবে বন্ধ হওয়া উচিত না। নতুন কুঁড়ি কেন বন্ধ হলো? এটা উচিত না। আমি জানি না দেশের টেলিভিশন স্টেশন কারা চালান, তাঁদের মাথায় কী চলে। আমাদের পাশের দেশেই রিয়েলিটি শোর টিআরপি অনেক বেশি। এটা দিয়ে ইন্ডাস্ট্রি যেমন সমৃদ্ধ হচ্ছে, বাণিজ্যও হচ্ছে।’

এমন প্রতিযোগিতাকে অনেক বড় সুযোগ হিসেবে দেখছেন অভিনেতা ও নির্দেশক তারিক আনাম খান। তাঁর কথায়, ‘আমরা কিন্তু চ্যালেঞ্জ নিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেছি। তখন একটা মিডিয়া ছিল, সুযোগ কম ছিল। টিকে থাকতে প্রচুর মহড়ার মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হতো। সুস্থ প্রতিযোগিতা খুব দরকার। থিয়েটার আগে শেখার অনেক বড় জায়গা ছিল, এখন আগের মতো সে সুযোগ সবাই করে দিতে পারছে না। তাই এই ধরনের প্রতিযোগিতা অনেক প্রয়োজন।’তরুণ প্রতিযোগীদের মাঝে শেখার আগ্রহ স্বপ্ন দেখায় তারিক আনাম খানকে। সঙ্গে তরুণদের থেকেও নিজে অনেক কিছু শিখছেন বলে জানিয়েছেন তিনি। তিনি বললেন, ‘ওদের মাঝে জানার আগ্রহ প্রবল, ওদের মাঝে চেষ্টাটা দেখেছি। ওদের থেকে অনেক কিছু নিজেও শিখছি। ৩০ বছর ধরে আমার মাঝে যে ইমোশন ছিল, এখন কি তাই ডেলিভারি দেব? নাকি এখন পৃথিবী যেখানে এগিয়েছে, তা করব? আমরা সবাই তো গ্লোবাল কানেক্টেড। তো ওদের সঙ্গে মেশার ফলে নিজের মাঝেও অনেক পরিবর্তন এসেছে।’

তিন হাজারের বেশি প্রতিযোগীকে নিয়ে শুরু হয়েছিল ‘দীপ্ত স্টার হান্ট’। বিভিন্ন রাউন্ড শেষে পারফরম্যান্স দিয়ে জুরিবোর্ড নির্বাচিত করেছে সেরা দশ প্রতিযোগীকে। তাদের মধ্যে আছেন শফিউল রাজ, হাফিজ রহমান, শাকিব হোসেন, শিমুল বিশ্বাস, এম এস এইচ লাবন, সানজিদা চৌধুরী, নূপুর আহসান, মিষ্টি ঘোষ, ফারিহা রহমান ও শেখ ফারিয়া হোসেন। এদিন কমেডি রাউন্ডে অংশ নিয়েছেন ১০ জনই। বিরতিতে কথা হয় এর মাঝে চারজন প্রতিযোগীর সঙ্গে। এ প্রতিযোগিতাকে ক্যারিয়ারের স্কুলিং হিসেবে দেখছেন তাঁরা।

প্রতিযোগীদের একজন নূপুর আহসান। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়ছেন তিনি। থিয়েটারের হাতেখড়ি ঢাকা পদাতিকে। এ প্রতিযোগিতায় আসার পর পরিবার থেকে বন্ধুদের দারুণ উৎসাহ পেয়েছেন তিনি। তবে প্রথমে ইচ্ছা ছিল না। এক বন্ধু জোর করে রেজিস্ট্রেশন করায় নূপুরের। প্রথম অডিশনের স্মৃতি মনে করে তিনি বলেন, ‘মাঠভর্তি মানুষ দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, কী অবস্থা এখানে কেন আমাকে নেবে। একে একে তিনটি রাউন্ড পার করে যখন সেরা ৪০–এ পৌঁছাই, তখন নিজের বিশ্বাস আসে। এরপর গ্রুমিংয়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছি। এভাবেই সেরা দশে চলে আসি। সেরা দশ কেন, এই প্রতিযোগিতায় আসব কল্পনা করিনি।’

ক্যারিয়ারের শুরুতে তারিক আনাম খান, শিহাব শাহীন ও মিথিলাকে বিচারক হিসেবে পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছেন এই প্রতিযোগী। তাঁর কথায়, ‘আমি অনেক ভাগ্যবান, শুধু আমার বলব না, এখানে যাঁরা আছেন সবার ক্যারিয়ার শুরু হয়েছে এমন তিনজন গুণী বিচারকের হাত ধরে। আমরা প্রতিনিয়ত তাঁদের থেকে শিখছি। প্রতিটা রাউন্ড শেষে তাঁদের সমালোচনা আমাদের পরবর্তী পারফরম্যান্সে অনেক কাজে দিচ্ছে। এখানে না এলে তাঁদের সান্নিধ্য এমন করে কিন্তু পেতাম না। প্রতিযোগিতা–সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ। ক্যারিয়ারে যদি কিছু করতে পারি, তখন প্রথম দিকের স্মৃতি স্মরণ করে নস্টালজিক হব, আমার শুরুটা যে তারিক আনাম খান, শিহাব শাহীন ও মিথিলা মিসের তত্ত্বাবধানে শুরু হয়েছে।’এ প্রতিযোগিতা আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে বলে মনে করেন নূপুর। তিনি বলেন, ‘সেরা চল্লিশে আসার আগে কনফিডেন্ট (আত্মবিশ্বাসী) ছিলাম না। এখন আছি। বিশ্বাস করি অনেক দূর যেতে পারব। এই একটাই লক্ষ্য কাজ করে।’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র শাকিব হোসেন। কাজ করছেন ক্যামেরার পেছনে। তাঁর নির্দেশিত কিছু স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রও জায়গা পেয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে। ক্যামেরার সামনে কাজ করার আগ্রহ কখনো তেমন না জন্মালেও প্রতিযোগিতার ফেসবুক পোস্ট দেখে নিবন্ধন করে ফেলেন তিনি। প্রথম দিনেই হয়ে যান নার্ভাস, চা খেতে গিয়ে সিরিয়াল মিস করেন। তবে ব্যক্তিজীবনে ভীষণ আত্মবিশ্বাসী শাকিব সেরা চল্লিশ, বিশ ও ষোলো পেরিয়ে পৌঁছে যান সেরা দশে। শাকিব স্বপ্ন দেখেন নির্মাণের পাশাপাশি পর্দার সামনেও তিনি ছাপ ফেলবেন।

শাকিব বলেন, ‘ব্যক্তিজীবনে আত্মবিশ্বাসী, আমি জানি আমি সেরা। ছোট থেকেই স্টেজে পারফর্ম করেছি, তাই নার্ভাসনেস (উদ্বিগ্ন) ছিল না। পড়াশোনা ও ক্যামেরার পেছনে কাজ করার ফলে টেকনিক্যাল জিনিস সম্পর্কেও আমার অনেক জানা আছে। দৃঢ় প্রত্যাশা, বড় জায়গায় নিজেকে দেখতে চাই। পর্দার সামনে ও পেছনে দুই জায়গাতেই নিজের সেরাটা দিতে চাই।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন ফারিহা রহমান। করপোরেট লাইফে ভালো থাকলেও নতুন এক্সপেরিয়েন্সের চাওয়া থেকেই নিবন্ধন করেন। আগে কখনো অভিনয় না করলেও, ছোট থেকে নাচ শিখতেন তিনি। প্রতিযোগিতায় থিয়েটার ব্যাকগ্রাউন্ডের অনেক প্রতিযোগীকে দেখে ভয় পেয়েছিলেন ফারিহা। কিন্তু তাঁর প্রতিভা ও পরিশ্রম তাঁকে নিয়ে গেছে সেরা দশে। তাঁর কথায়, ‘সেরা দশে থাকব, তা চিন্তায়ও ছিল না। অনেক মিডিয়া ব্যাকগ্রাউন্ডের মানুষজন দেখে আত্মবিশ্বাস কমে গিয়েছিল। তবে বিজ্ঞ জুরিবোর্ডের বিশ্লেষণ ও পরামর্শে আজ সেরা দশে আসতে পেরেছি। সবারদোয়া থাকলে সামনে আরও বড় কিছু হতে পারে।’তারিক আনাম খানের মতো মানুষকে ক্যারিয়ারের শুরু পাওয়ায় নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছেন ফারিহা। তাঁর কথায়, ‘ক্যারিয়ারের শুরুতে তারিক আনাম স্যারসহ অভিজ্ঞ বিচারকদের পাওয়া আমার জন্য অনেক বড় কিছু। তাঁরা তো প্রতিষ্ঠান।’আয়োজকেরা জানিয়েছেন, শুধু প্রতিভা খোঁজা নয়, প্রতিযোগিতার সেরা প্রতিযোগীদের আগামী দুই বছরের জন্য টিভি সিরিজ, ওয়েব সিরিজ, ওয়েব ফিল্ম ও বড় পর্দায় কাজের সুযোগ পাবেন। ইতিমধ্যে তাঁদের নিয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রও নির্মাণ করা হয়েছে। ‘দীপ্ত স্টার হান্ট’ অনুষ্ঠানটি দীপ্ত টিভিতে প্রচারিত হয় প্রতি শুক্র ও শনিবার রাত ১০টায়। এর গ্রন্থনায় রয়েছেন আহমেদ খান, চিত্রনাট্যে ফাহমিদুর রহমান, মারুফ ইমন, আসফিদুল হক। সুর ও সংগীতে খৈয়াম সানু সন্ধি, শিল্প নির্দেশনা কামাল সামসুদ্দিন, কোরিওগ্রাফিতে আসাদ খান, পরিকল্পনা ও সার্বিক তত্ত্বাবধানে তাসনুভা আহমেদ, পরিচালনায় ওয়াহিদুল ইসলাম ও নির্বাহী প্রযোজক হিসেবে আছেন সাইফুর রহমান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *