যখন আধুনিকতার ঝলক আর শব্দের কোলাহলে সংগীতের অন্তর্গত নীরবতা প্রায় হারিয়ে যায়, তখন এক শিল্পী নীরবে নিজের আলোকরেখা ধরে হেঁটে চলেন– তিনি চঞ্চল খান। রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা ও জীবনব্যাপী সাধনা আজ রবীন্দ্রনাথের গানের ভাষাকে ছড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। সত্তর দশকের ছায়ানটের দিনগুলো থেকে শুরু করে ভারত, বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া ও বিশ্বের বহু দেশে তিনি গড়ে তুলেছেন এক দীর্ঘ, মননশীল যাত্রা–যেখানে গান মানে ভক্তি, চিন্তা আর আত্ম-অন্বেষার এক সেতুবন্ধ।
এই দীর্ঘ সৃজনপথের সর্বশেষ মণিকাঞ্চন সংযোজন হলো ভারতের প্রাচীনতম রেকর্ড কোম্পানি হিন্দুস্তান রেকর্ডসের প্রকাশনা ‘Whispers of the Soul’ (আত্মার নিঃশব্দ গান)। এটি এক অভূতপূর্ব উদ্যোগ, রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির কবিতা ও গানকে একত্রে বুনে তৈরি হয়েছে এক অনন্য সিম্ফোনিক সংলাপ। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলির জন্য রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার। এবার সেই অমর কবিতাগুলোর ইংরেজি অনুবাদ পাঠ করছেন চঞ্চল খান নিজেই। এর পরেই তাঁর কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে সেই একই ভাবের রবীন্দ্রসংগীত– কবিতা ও গানের মধ্যে যেন আত্মার এক নীরব সংলাপ।
প্রথম পর্বে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে– ‘আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ,’ ‘তুমি একটু কেবল বসতে দিয়ো কাছে’, ‘আমারে তুমি অশেষ করেছ’, ‘তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী’, ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার’, ও “মেঘের ’পরে মেঘ জমেছে”– এইসব ধ্যানমগ্ন গান। সূক্ষ্ম বাদ্যযন্ত্র, কোমল সুর আর ব্যঞ্জনাময় আবৃত্তির মেলবন্ধনে এগুলো যেন রূপ নিয়েছে এক আত্মিক সংগীতে– যা মানুষের ভেতরের আলোকে ছুঁয়ে যায়।
বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারের শিল্পী হিসেবে চঞ্চল খানের কণ্ঠ বহুদিন ধরেই শ্রোতাদের কাছে নির্মলতা ও গভীর অনুভবের প্রতীক। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি শুধু শিল্পী নন; একজন শিক্ষক, গবেষক ও সংগঠক। তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন অস্ট্রেলিয়ায় সুরলোক ও নেপালে আনন্দলোক, যেখানে রবীন্দ্রসংগীতের শিক্ষা ও সাধনার সঙ্গে যুক্ত হয় সাংস্কৃতিক সংলাপের চর্চা। ‘টেগোর সোসাইটি ঢাকা’র সভাপতি হিসেবে তিনি আজ বিশ্বজুড়ে থাকা দ্বাদশ টেগোর সোসাইটির এক গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠ।
চঞ্চল খান আলোয় নয়, থাকেন প্রশান্ত ছায়ায়। তিনি প্রচারের মোহে পড়েন না, খ্যাতির পেছনে ছোটেন না। তাঁর কাজই তাঁর পরিচয়। শ্রোতারা বলেন, তাঁর গানে শুধু সুর নয়; থাকে চিন্তা, থাকে অনুভবের পরিশুদ্ধতা। ভারত, বাংলাদেশ কিংবা প্রবাস– সবখানেই তিনি এক নিবেদিত শ্রোতাদের ভালোবাসায় ঘেরা, যারা তাঁর গানের ভেতর খুঁজে পান শান্তি ও গভীর ভাবনা।
তাঁর বিনয়ই তাঁর শক্তি। প্রখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাঁকে প্রায়ই আমন্ত্রণ জানায় বক্তৃতা ও কর্মশালার জন্য। ভারতের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ইউরোপ ও আমেরিকার নানা সাংস্কৃতিক মঞ্চে তিনি কথা বলেন সংগীত, রবীন্দ্রদর্শন আর সৃজনশীলতার মাধ্যমে মানব উন্নয়ন নিয়ে। তাঁর বক্তৃতা কেবল একাডেমিক নয়; সেখানে গান মিশে যায় দর্শনে, বোধ মিশে যায় আবেগে। শ্রোতারা বলেন, তিনি যেন একযোগে শিক্ষক, দার্শনিক ও সাধক।
শুধু সংগীতশিল্পী নয়, চলচ্চিত্রকার হিসেবেও তিনি রেখেছেন উজ্জ্বল ছাপ। ২০১১ সালে নির্মিত তাঁর প্রামাণ্যচিত্র ‘বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ’ ছিল চিত্রায়ণে এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। ১৯৬১ সালে সত্যজিৎ রায়ের কাজের পর এমন গবেষণানির্ভর কোনো প্রামাণ্যচিত্র আর দেখা যায়নি। ২০১৫ সালে নির্মাণ করেন ‘টাইমলেস গীতাঞ্জলি’– যা প্রদর্শিত হয়েছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ায়। ২০২৩ সালে তাঁর আধা নাটকীয় প্রামাণ্যচিত্র ‘ছিন্নপত্র’– রবীন্দ্রনাথ ও ইন্দিরা দেবীর পত্রালাপের এক আবেগময় চলচ্চিত্ররূপ– চলচ্চিত্রজগতের পরিণত রূপ।
তরুণ প্রজন্মকে উৎসাহ দিতে ও বিচার করতে তিনি দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত রয়েছেন নানা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায়– বাংলাদেশ টেলিভিশনের সংগীত প্রতিযোগিতা থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়ার বহু সাংস্কৃতিক সংগীত উৎসব পর্যন্ত। ন্যায্যতা, রুচি ও সংগীতবোদ্ধা হিসেবে তিনি আজ এক নির্ভরযোগ্য নাম বিচারকমণ্ডলীতে।
চঞ্চল খানের একক অ্যালবামের সংখ্যা সাত। এর মধ্যে ‘খুশি থাকো’ (কলকাতার সারেগামা, ২০১৫) ও ‘প্রাঙ্গণে মোর’ (ঢাকার জি সিরিজ, ২০১৫) বিশেষভাবে প্রশংসিত। রবীন্দ্রনাথের ব্যঙ্গাত্মক ও রম্য গান নিয়ে তাঁর অ্যালবামটি কলকাতা ও ঢাকায় প্রকাশিত হয়েছিল– যা একাধারে রসিকতা ও ভক্তির মেলবন্ধন। সংগীত পরিচালক, চিত্রশিল্পী ও অনুবাদক হিসেবেও তিনি সমান সিদ্ধহস্ত। রবীন্দ্রনাথের গানের ইংরেজি অনুবাদ অনেক বিদেশি শ্রোতার কাছে উন্মোচন করেছে নতুন এক জগৎ; তাঁর চিত্রকলায় প্রতিফলিত হয়েছে জীবনানন্দ দাশ ও শামসুর রাহমানের কবিতার প্রতিধ্বনি।
জননীতি বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রিধারী মানুষটি জাতিসংঘ, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও বিশ্বব্যাংকের হয়ে কাজ করেছেন ৩৫টিরও বেশি দেশে। উন্নয়ন, নীতি ও মানবিকতার এই আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা তাঁর সংগীতকে করেছে আরও মানবিক, আরও পরিণত। তাঁর নিজের ভাষায়– ‘সংগীতও এক ধরনের জনসেবা। এটি মানুষকে উঁচুতে তোলে, জোড়ে, আরোগ্য দেয়; যেমনটা ভালো শাসন ব্যবস্থায়ও করা উচিত।’
তাঁর সঙ্গে একবার কথা বললেই বোঝা যায়, তিনি আড়ম্বরহীন এক মানুষ। যিনি শ্রোতা, ছাত্র বা সহশিল্পী– সবার সঙ্গে কথা বলেন সমান বিনয়ে, সমান উষ্ণতায়। তাই অনেকে বলেন, তাঁকে শুনতে বসলে গান নয়, যেন ধ্যান শোনা যায়।
হিন্দুস্তান রেকর্ডস যখন প্রকাশের প্রস্তুতি নিচ্ছে ‘Whispers of the Soul’ (আত্মার নিঃশব্দ গান) তখন শুধু রবীন্দ্রভক্ত নয়, বিশ্বজুড়ে সংগীতপ্রেমীরাও অপেক্ষায় আছেন এক নতুন অভিজ্ঞতার জন্য। প্রকল্পটি প্রজন্ম ও ভৌগোলিক সীমানা অতিক্রম করে মানবাত্মার সঙ্গে সংগীতের এক চিরন্তন মিলনের প্রতিশ্রুতি বহন করছে।
যারা চঞ্চল খানের শিল্পযাত্রা অনুসরণ করেছেন, তাদের কাছে ‘Whispers of the Soul’ যেন এক অনিবার্য গন্তব্য। জীবনের সাধনার স্বাভাবিক পরিণতি। নতুন শ্রোতাদের জন্য এটি হতে পারে এক আলোকদ্বার, যেখানে গীতাঞ্জলি আর ইতিহাস নয়; বরং মানুষের সঙ্গে দেবতার এক জীবন্ত আলাপ। চঞ্চল খানের কাছে এটি শুধু আরেকটি পদক্ষেপ– যাত্রার, যা শুরু হয়েছিল বহু বছর আগে। খ্যাতি বা প্রাপ্তির জন্য নয়, ভালোবাসা, শৃঙ্খলা ও বিশ্বাসের জন্য। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘এই গানগুলো থাকবে, কথা বলবে, যখন আমাদের কণ্ঠ থেমেও যাবে– তবু আত্মার নিঃশব্দ গান বয়ে যাবে অনন্তের পথে।’