হেনিং-এর ফ্রেমে, যুদ্ধদিনের বাংলাদেশ

১৯৭১ সাল, বাঙালি জাতির জীবনে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আর গৌরবের ইতিহাস। এই ইতিহাসের প্রতিটি মুহূর্ত–মানুষের অদম্য সংগ্রাম, বুকফাটা শোক, অসীমের আশা এবং অবশেষে বিজয়ের উল্লাস–ক্যামেরার ফ্রেমে ধরে রেখেছিলেন যে গুটিকয়েক নির্ভীক মানুষ, ফ্রান্সের বিখ্যাত ফটো সাংবাদিক অ্যান দে হেনিং (অহহব উব ঐবহহরহম) তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর তোলা ছবিগুলো শুধু আলোকচিত্র নয়, বরং বাংলাদেশের জন্ম–মুহূর্তের এক জীবন্ত, বাস্তব দলিল।

হেনিংয়ের বয়স তখন মাত্র ২৬ বছর। দক্ষিণ এশিয়া ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তিনি। ছিলেন নেপালে। বাংলাদেশে পাকিস্তানি মিলিটারির ক্র্যাকডাউনের খবর শুনে হেনিং পরিচয় গোপন করে ভারতের কোলকাতা হয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েন।

​মুক্তিযুদ্ধের সময় বহু আন্তর্জাতিক সাংবাদিক পূর্ব পাকিস্তানে (তৎকালীন বাংলাদেশ) এসেছিলেন, কিন্তু হেনিং–এর কাজের ধরণ তাঁকে এক স্বতন্ত্র উচ্চতা দিয়েছে।

অ্যান দে হেনিং দীর্ঘসময় ধরে বাংলাদেশের মানুষের পাশে ছিলেন। তিনি যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, এমনকি স্বাধীনতার পরও কয়েক মাস এ অঞ্চলের পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ ও ধারণ করেছেন। এর ফলে তাঁর ছবিতে কেবল তাৎক্ষণিক ঘটনা নয়, বরং সময়ের সাথে সাথে মানুষের মানসিক পরিবর্তন এবং জাতির বিবর্তনের চিত্র ফুটে উঠেছে।

তিনি যুদ্ধাঞ্চলে মুক্তিবাহিনী, শরণার্থী ট্রেনে করে পালিয়ে যাওয়া পুরুষ, মহিলা ও শিশুদের ছবি তুলেছিলেন, যা আন্তর্জাতিক মহলে যুদ্ধের বাস্তব চিত্র তুলে ধরে। মূলত, যুদ্ধাহত দেশে তিনি সংঘাতের সত্য খবর ও মানবতার চিত্র বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য এসেছিলেন। তাঁর ফটোগ্রাফিতে যুদ্ধ–সংঘাতের ভয়াবহতা যতটা তীব্রভাবে প্রকাশ পেয়েছে, ঠিক ততটাই স্পষ্ট হয়েছে সাধারণ মানুষের অদম্য প্রাণশক্তি, পারস্পরিক সহযোগিতা এবং বিজয়ের জন্য আকুলতা। তিনি কেবল যুদ্ধের দৃশ্য নয়, মানুষের শোক, আশা ও মানবিক সম্পর্ককে তাঁর লেন্সে তুলে ধরেছেন। শরণার্থী শিবিরে মানুষের দুর্দশা, মুক্তিযোদ্ধাদের চোখে স্বাধীনতার স্বপ্ন এবং বিজয়ের পর স্বজন হারানোর বেদনা, এই সবকিছুরই প্রমাণ বহন করে তাঁর কাজ। এরপর সেসব সংগ্রামের খণ্ড খণ্ড দৃশ্য নানাদেশের গণমাধ্যমে আসতে শুরু করল। পৃথিবী জানতে শুরু করে এই নারকীয় গণহত্যার খবর।

হেনিং নিজেকে কেবল পর্যবেক্ষক হিসেবে রাখেননি, তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সরাসরি রণাঙ্গনে ছুটে গেছেন। তাঁর ছবিতে মুক্তিযোদ্ধারা, এমনকি গেরিলা যোদ্ধারাও জীবন্ত হয়ে উঠেছেন। এই ছবিগুলোই আন্তর্জাতিক মহলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে এক শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছিল।

​অ্যান দে হেনিং–এর কাজকে বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ থিম বা উপজীব্য খুঁজে পাওয়া যায়। যুদ্ধ শুরু হলে ভারতের দিকে লাখ লাখ মানুষের স্রোত নেমেছিল। হেনিং–এর ক্যামেরায় সেই অভুক্ত, আশ্রয়হীন মানুষের অসহায় মুখগুলো অত্যন্ত শক্তিশালীভাবে ধারণ করা হয়েছে, যা যুদ্ধাপরাধের ভয়াবহতা তুলে ধরে।

তাঁর তোলা মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি, বিশেষ করে অল্পবয়সী এবং প্রশিক্ষণে থাকা তরুণদের ছবিগুলো, বাঙালির প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে আছে। এগুলো সেই সময়ে বিশ্বকে বার্তা দিয়েছিল যে এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং সুসংগঠিত গণ–প্রতিরোধ।

​১৯৭১ সালের ঢাকা বা অন্যান্য শহরের জনশূন্য রাস্তা, কারফিউ এবং সামরিক বুটের ছাপ–এই ছবিগুলো হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের একটি নীরব চিত্র তুলে ধরে।

​১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১–এর বিজয়ের পর জনগণের বাঁধভাঙা আনন্দ এবং একই সাথে স্বজন হারানোর চাপা কান্না, দুটোকেই তিনি অত্যন্ত সংবেদনশীলভাবে ক্যামেরাবন্দী করেছেন।

​অ্যান দে হেনিং–এর ছবিগুলো বিশ্বখ্যাত ‘প্যারিস ম্যাচ’ (চধৎরং গধঃপয) এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। এগুলো বিশ্বজুড়ে মানুষের কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামকে মূর্ত করে তোলে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে যখন পাকিস্তানের সামরিক জান্তার অপপ্রচারের বিপরীতে সত্যের দলিল প্রয়োজন ছিল, তখন আরও অনেক আলোকচিত্রীর মধ্যে হেনিং–এর ছবিগুলোই ছিল শক্তিশালী প্রমাণ।

২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ফ্রান্সে “ডকুমেন্টিং বাংলাদেশ ওয়ার” নামে হেনিংয়ের একক প্রদশর্নীর আয়োজন করা হয়। বহুবছর পর সেই প্রদর্শনীতে আবার সেসব দুর্লভ ছবির দেখা মেলে। এবং একই নামের একটি বই প্রকাশ করেন। এই উদ্যোগ বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের একেবারে বাস্তবচিত্র দেখতে ও অনুধাবন করতে সাহায্য করেছে।

​অ্যান দে হেনিং কেবল একজন ফটো সাংবাদিক নন, তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের এক নীরব সাক্ষী। তাঁর ক্যামেরা ছিল একাত্তরের যুদ্ধক্ষেত্রে সত্যের এক মশাল। তাঁর তোলা প্রতিটি ছবি বাঙালির সংগ্রাম, আত্মত্যাগ এবং বিজয়ের এক একটি অধ্যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে তাঁর এই আলোকচিত্রের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *