লায়লা খালিদ: ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামের প্রতীক

২০১৭ সালে মিশর ভ্রমণের সময় প্যালেস্টাইনের এক পরিবারের সাথে আমার পরিচয় হয়। মা ও মেয়ে। তারা দীর্ঘকাল ধরে কায়রোতে বসবাস করছেন। মেয়েটা স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। প্যালেস্টাইনী শুনে আমি আগ্রহী হয়ে আলাপ জমালাম। দশকের পর দশক ধরে তারা তাদের অস্তিত্বের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববাসী নিরন্তর তাদের সাথে ঘটে যাওয়া নিষ্ঠুরতম ঘটনাগুলোর সাক্ষী হচ্ছে। শিশু হত্যা, নারী হত্যা, নিরীহ মানুষ হত্যা ও ঘরবাড়ি, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমনকিছু নেই যা তারা ধ্বংস করছে না। ১৯২০ সালে জাতিসংঘ ঘোষণার মাধ্যমে ব্রিটিশেরা ‘ম্যান্ডটরি প্যালেস্টাইন’ প্রতিষ্ঠা করে। তখন থেকেই ইহুদিদের আধা সামরিক বাহিনী আরব ফিলিস্তিনীদের মূল ভূখণ্ড থেকে বিতরণ করতে শুরু করে। ইসরায়েলের নানা বাহিনী হত্যা, ধর্ষণ ও ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে ফিলিস্তিনীদের বাধ্য করে দেশ ছেড়ে চলে যেতে। ফিলিস্তিনীদের জাতিগত নিধনের অংশ হিসেবে এরাও হয়তো বা আজ কায়রোর অধিবাসী। কথা প্রসঙ্গে বললাম, আপনাদের মুক্তি সংগ্রামের প্রতীক লায়লা খালিদের কথা, সেই শৈশবেই শুনেছি। আজও তাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। আমাকে হতবাক করে দিয়ে বললেন, তারা তাঁকে চিনে না! তারপরেও আমি বলতে থাকলাম তাঁর অসাধারণ বীরত্বের কথা! তিনি তোমাদের স্বাধীনতার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইসরায়েলের বিমান হাইজ্যাক করেছে দুই দুইবার। এইভাবে প্যালেস্টাইনী স্বাধীনতার প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি তো স্বাধীনতাকামী প্যালেস্টাইনের মানুষের মুক্তির প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন সারা বিশ্বে । আমার গল্প শুনে ‘আইওয়া’ও ‘শুকরান’ বলে উঠে পড়লেন। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। ফিলিস্তিনিরা তাদের কিংবদন্তি লায়লা খালিদকে মনে রাখেনি! আমার নিজের স্বদেশের কথা মনে হলো। আমরাই বা কতটা মনে রেখেছি আমাদের বীরদের? এখন কি সব মুছে ফেলতে চাইছি না? নাকি বিশ্বব্যাপী সেক্যুলার বামপন্থীদের পতন ও উগ্র দক্ষিণপন্থীদের উত্থানই ভুলিয়ে দিচ্ছে লায়লা খালিদদের অবদানকে?

লায়লা খালিদের জন্ম প্যালেস্টাইনের হাইফায়ে।

তার বয়স যখন চার বছর তার বাবা তার পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে তাদের দক্ষিণ লেবাননে পাঠিয়ে দেন। তিনি থেকে যান। যুক্ত হন স্বদেশ মুক্তির লড়াইয়ে। লায়লা খালিদ তার প্রিয় বাবাকে আর কখনও দেখেননি। স্বদেশ ছেড়ে যাওয়ার বেদনা আর বাবাকে হারানোর ক্ষত তিনি আজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন। এই রক্তাক্ত ক্ষত তাকে উদ্বুদ্ধ করে দেশকে মুক্ত করার লড়াইয়ে নিজেকে যেকোনো ঝুঁকি নিয়ে হলেও সম্পৃক্ত করার। তার কাছে ফিলিস্তানীদের এই উদবাস্তের জীবন ছিল অবজ্ঞা ও অপমানের! রেশনকার্ড আর কম্বলের জন্য অনুগতভাবে হাঁটা অথবা একে–৪৭ হাতে নেওয়া এই দুই বিকল্পের পরেরটিই ছিল তার কাছে আত্মমর্যাদর! অদম্য ইচ্ছে থেকে যুক্ত হয়েছিলেন পিএফএলপি তে। যুক্ত হওয়ার পর থেকে ছোটখাটো অপারেশনের মাধ্যমে নিজের শক্ত অবস্থান তৈরি করে নেন। ১৯৬৭ সালে আরব ইসরায়েল যুদ্ধেও তিনি বিভিন্ন দুঃসাহসিক অভিযানে অংশগ্রহণ করেন।

১৯৬৯ সালের ২৯ শে অগাস্ট সেই লোমহর্ষক ইসরায়েলী বিমান হাইজ্যাকের অভিযান! সশস্ত্র উপায়ে নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এই বিপ্লবী প্রতিবাদের সমর্থনে আলোচনার ঝড় তুলেছিলো বিশ্বজুড়ে। তিনিই প্রথম নারী যিনি দাবী আদায়ে এমন শ্বাসরুদ্ধকর দুঃসাহসিক অভিযানে অংশ নেন। তার সেই দুঃসাহসী অভিযানটি ছিল রোমাঞ্চকর কোন থ্রিলার সিনেমার মতো! এই ঘটনাটিও ছিল অভূতপূর্ব! এর আগে কোন নারী কর্তৃক এমন বিমান হাইজ্যাকের ঘটনা ঘটেনি! সেইদিন রোম এয়ারপোর্টে ইসরায়েলী ফ্লাইটের অপেক্ষায় বসেছিলেন অড্রে হেপবার্নের মতো দেখতে সুদর্শনা লায়লা খালিদ ও তার সহযোগী সেলিম। লায়লা খালিদের মাথায় ছিল গোলাকার সান হ্যাট ও চোখে পরেছিলেন কালো রোদচশমা। তাঁরা এমন ভান করছিলেন যেন তাদের মধ্যে কোন জানাশোনা নেই! ফ্লাইটে তারা তাদের নির্ধারিত বিজনেস ক্লাসে বসলেন। এটাও ছিল তাদের পরিকল্পনার অংশ। তারা এজন্যই বিজনেস ক্লাসে বুকিং করেছিলেন যেন তারা সহজেই বিমানের ককপিটে প্রবেশ করতে পারেন। বিমানবালা লায়লার পছন্দ অনুযায়ী কফি ও সেলিমকে বিয়ার পরিবেশন করে। এরপর বিমানবালা তাকে খাবার নেওয়ার অনুরোধ জানালে তিনি বলেন তিনি অসুস্থ বোধ করছেন, খাবেন না,তাকে যেন আরও একটা কম্বল দেওয়া হয়। কম্বল পাওয়ার সাথে সাথে তিনি তার কাছে থাকা হ্যান্ড গ্রেনেড ও পিস্তল কম্বলের নীচে রাখেন। এদিকে বিমানবালা যাত্রীদের খাবার পরিবেশনের সময় হঠাৎ সেলিম লাফিয়ে উঠে বিমানের ককপিটে পৌঁছে যায়। তখন লায়লা খালিদ ও তার কাছে থাকা হ্যান্ড গ্রেনেড ও পিস্তল নিয়ে সেলিমের পিছনে গিয়ে দাঁড়ান। এবং তারা উভয়ে চিৎকার করে বলতে থাকে প্রথম শ্রেণির সব যাত্রী এবং ক্রুরা যেন ইকোনমি ক্লাসে অবস্থান নেয়।

এই ছিনতাইয়ে লায়লা খালিদ নিজেই পাইলট ও এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সাথে কথা বলেন। প্রথমে তিনি ইসরায়েলের লোদ বিমান বন্দরে নিয়ে যেতে বলেন। বিমানটি ইসরায়েলে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে দুই পাশে দুটি মিরাজ বিমান উড়তে শুরু করে। এতে যাত্রীরা আরও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এই বুঝি গুলি করে ভূপতিত করে দিলো বিমানটি!! লায়লা লোদ বিমান বন্দরের লোদের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সাথে যোগাযোগ করেন এবং বলেন, এখন আপনারা আমাদের ফ্লাইটকে বি ডব্লিউ এ ৮৪০ বলার পরিবর্তে ফ্লাইট পি এফ এল পি ফ্রি আরব প্যালেস্টাইন বলে সম্বোধন করবেন।

বিমানের পাইলট প্রথমে লায়লার নির্দেশ মানতে অস্বীকার করলেও তার হ্যান্ড গ্রেনেড দেখানোর পর নির্দেশ মানতে শুরু করে। তবে লোদ বিমান বন্দরের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই হঠাৎ লোদের উপর দিয়ে দ্রুত দামেস্ক বিমান বন্দরের দিকে উড়ে যায়। লোদে অবতরণ করার কথাটা ছিল ইসরায়েলকে বোকা বানানোর জন্য তাদের পরিকল্পনার অংশ। এবার যেতে যেতে তার জন্মভূমি হাইফার উপর দিয়ে যেতে বলেন। লায়লা তার আত্মজীবনীতে লিখছেন “যখন আমি আমার জন্মভূমির দিকে তাকালাম তখন আমি ভুলে গিয়েছিলাম আমি কোন অভিযানে আছি, চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিলো, এই দেখো আমি ফিরে এসেছি! আমার মুখ লাল হয়ে গিয়েছিলো। সমস্ত লোম দাঁড়িয়ে গেছিলো। নিজেকে সহসা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলামনা!” অবশেষে দামেস্ক বিমান বন্দরে নিরাপদ অবতরণের পর তার সহযোগী সেলিম বিমানের ককপিটে বিস্ফোরক দ্রব্য রেখে বিমানটি ধ্বংস করে ফেলে। এটিই ছিল ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণের কার্যকর উপায়। এরপর ১৯৭০ সালে তিনি আরও একটা ইসরায়েলী বিমান ছিনতাই করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাদের এই অভিযান সফল হয়নি। তিনি ব্রিটিশ বাহিনীর হাতে বন্দী হন। এবং মারাত্মকভাবে আহত হন। তার এক সহযোগীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। প্রায় চব্বিশ দিন ব্রিটিশ কারাগারে থাকার পর তিনি মুক্তি পান। তাঁর বয়স এখন আশির উপরে। জর্ডানে তার পরিবারের সাথে বসবাস করছেন। তাঁর স্বামী একজন নামকরা চিকিৎসক। তাদের দুই সন্তান। ব্রেনে রক্তক্ষরণ নিয়ে জীবনের সাথে লড়ে যাচ্ছেন। এখনও স্বপ্ন দেখেন মুক্ত স্বদেশের! এখনও স্বপ্ন দেখেন তাঁর নিজ ভূমিতে ফিরে যাওয়ার! এখনও স্বপ্ন দেখেন ঐ পোড়া মাটির উপর দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে, আমি, আমরা ফিরে এসেছি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *