প্রতি বছর ১৫ অক্টোবর বিশ্বজুড়ে উদযাপিত হয় আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস। দিনটি মূলত গ্রামীণ অর্থনীতি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং টেকসই উন্নয়নে গ্রামীণ নারীদের বিশাল ও অপরিহার্য ভূমিকাকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য নিবেদিত। ১৯৯৫ সালে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের চতুর্থ নারী সম্মেলনে এই দিবস উদযাপনের প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং ১৯৯৭ সাল থেকে এটি হয়ে আসছে। বাংলাদেশের মতো একটি কৃষিনির্ভর দেশে, গ্রামীণ নারীরাই খাদ্যশস্য উৎপাদন ও কৃষি উন্নয়নের নীরব কারিগর। তাদের জীবন কাঠামোগত বৈষম্য ও চ্যালেঞ্জে জর্জরিত হলেও, এই লড়াকু নারীরা আমাদের আশার আলো দেখাচ্ছেন।
কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার বাসিন্দা হালিমা খাতুনের (৪০) জীবনসংগ্রাম এর এক জীবন্ত দলিল। তাঁর দিন শুরু হয় সূর্য ওঠার আগে, শেষ হয় এশার আজানের পর। ভোর ৫টায় ঘুম থেকে উঠে রান্না, গবাদি পশুর যত্ন, হাঁস-মুরগিকে খাবার দেওয়া থেকে শুরু করে জমিতে বীজ রোপণ, আগাছা পরিষ্কার, সেচের ব্যবস্থা করা, ফসল তোলার পর ধান শুকানো, সেদ্ধ করা ও কিছু চাল ঢেঁকিতে ছাঁটা–এই সমস্ত কাজই তাঁকে একা সামলাতে হয়। অথচ এই কাজের মূল্যায়ন তাঁর পরিবার বা স্বামীর কাছে নেই। তাদের মতে, হালিমা বাড়ির কাজ করে আর ‘টুকটাক হাত লাগায়’। কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, কৃষিতে শ্রমদানকারী নারীর ৪৫.৬ শতাংশ পারিশ্রমিক পান না এবং হালিমার এই অস্বীকৃত শ্রম দিনে গড়ে ৬.২ ঘণ্টা পারিশ্রমিকহীন গৃহস্থালির কাজ হিসেবে জিডিপিতে প্রতিফলিত হয় না। সিদ্ধান্ত স্বামীর হলেও, অভাবের সময় ছোটখাটো ঋণ নিতে পারায় পরিবারে তাঁর মতামত কিছুটা গুরুত্ব পায়।
অন্যদিকে, রংপুরের সালমা বেগমের (৩২) জীবন-সংগ্রাম দেখায় অর্থনৈতিক মুক্তির পথ। অল্প বয়সে দারিদ্র্যের কারণে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়েই তাঁর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। কঠোর পরিশ্রমে তিনি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে বি.কম পড়া শুরু করেন। স্বামীর লোকসানের পর স্থানীয় যুব উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে নেওয়া প্রশিক্ষণের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে তিনি নকশিকাঁথা ও শতরঞ্জি তৈরি করে স্বাবলম্বী হন। সালমা এখন মাসে গড়ে প্রায় ১৫ হাজার টাকা উপার্জন করেন এবং গ্রামের আরও অন্তত ১৫ জন নারীকে এই কাজে যুক্ত করেছেন। উপার্জনের ফলে সন্তানেরা স্কুলে যেতে পারছে এবং পরিবারে তাঁর মতামতের গুরুত্ব তৈরি হয়েছে। বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান এখন শক্তিশালী। সালমার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়–শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ পেলে গ্রামীণ নারীর অর্থনৈতিক অগ্রগতি আসে এবং ক্ষমতায়নের পথ তৈরি হয়।
এই সাফল্যের উল্টো পিঠেই আছে প্রকট বৈষম্যের চিত্র। দেশের সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী, ৮৫ শতাংশ পরিবার পুরুষ দ্বারা পরিচালিত হয়। মাত্র ১৫ শতাংশ পরিবারের নেতৃত্বে আছেন নারী। এই তথ্য পরিবারের মধ্যেই নারীর নেতৃত্বের ভারসাম্যহীনতা তুলে ধরে। এছাড়াও গ্রামে মজুরিবৈষম্য প্রকট। লালমনিরহাটের নারীশ্রমিক সাবিনা আক্তারের (৪৩) মতো শ্রমিকরা পুরুষের সমান পরিশ্রম করেও কম মজুরি পান। যেখানে একজন পুরুষ শ্রমিক দৈনিক ৪০০-৫০০ টাকা মজুরি পান, সেখানে নারী শ্রমিকদের মজুরি দেওয়া হয় ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা পর্যন্ত। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক শরমিন্দ নীলোর্মি বলেন, ‘নারীর জন্য সমাজ যেসব কাজ স্বাভাবিক বলে বিবেচনা করে (যেমন অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজ), সেগুলো প্রধানত নিম্ন আয়ের। কৃষিতে নারী ও পুরুষের শ্রম মজুরির পার্থক্য প্রায় ২৫ শতাংশের মতো।’ তিনি নারীর কম মজুরি পাওয়ার কারণ হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তার অভাব এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করতে বাধ্য হওয়াকে দায়ী করেন।
বাজেট বিশ্লেষণ করলে এই বৈষম্যের চিত্র আরও স্পষ্ট হয়। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জাতীয় মাথাপিছু গড় বাজেট বরাদ্দ ছিল ৪৭,০৩২ টাকা, অথচ গ্রামীণ নারীর জন্য মাথাপিছু বরাদ্দ নাটকীয়ভাবে কমে মাত্র ১,৪৮৬ টাকা হয়; যা জাতীয় মাথাপিছু বাজেটের তুলনায় প্রায় ৯৬.৮ শতাংশ কম। এমনকি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জন্য মোট বাজেট বরাদ্দ বাড়লেও, তা বাস্তব চাহিদা পূরণের জন্য একেবারেই অপর্যাপ্ত। এই বরাদ্দগুলো মূলত শহরকেন্দ্রিক ও মধ্যবিত্ত নারীর উপযোগী প্রকল্পগুলোতে ব্যয় হয়, ফলে গ্রামীণ নারীর কৃষি, পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও জীবিকার সমস্যাগুলো প্রতিফলিত হয় না। গ্রামীণ নারী শ্রম দিলেও বাজেটে তাদের শ্রমের কোনো হিসাব নেই এবং উন্নয়ন প্রকল্পে তারা অধিকারভোগী হিসেবে নয়, বরং উপকারভোগী হিসেবে বিবেচিত হন।
আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস ২০২৫-এর মূল বার্তা ‘অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন’ তাই বাংলাদেশের গ্রামীণ নারীর জন্য গভীর তাৎপর্য বহন করে। এই নীরব কারিগরদের কেবল পরিসংখ্যানের অন্তর্ভুক্ত করাই যথেষ্ট নয়, তাদের ব্যক্তিগত জীবনের গল্পগুলোর স্বীকৃতি দিয়ে তাদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হিসেবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে অবশ্যই প্রতিটি নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা এবং আইনের সমান আশ্রয় নিশ্চিত করার মাধ্যমে বৈষম্য দূর করার অঙ্গীকার সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এই লক্ষ্যে বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন, যৌতুক নিরোধ আইন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন এবং পারিবারিক আদালত আইনের মতো নানাবিধ আইন ও বিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। এই আইনগুলো দেশের ৫১ শতাংশ জনগোষ্ঠীর অধিকারকে সমুন্নত করার এবং প্রাতিষ্ঠানিক বাধা নির্মূল করার কথা বললেও তা অর্জন সম্ভব হয়নি; কারণ এর বাস্তব প্রয়োগ আজও এক কঠিন চ্যালেঞ্জ।
এই পথে প্রধান অন্তরায় হলো আইনি ও বিচারিক কাঠামোর সীমাবদ্ধতা এবং সমাজের গভীরে প্রোথিত সামাজিক মনস্তত্ত্বের অচলায়তন। একদিকে, নারীর প্রতি সহিংসতা বা আইনি সমাধানে রাষ্ট্র যদি দ্রুত পদক্ষেপ না নিয়ে সময়ক্ষেপণকে নিয়মে পরিণত করে, তবে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা নারীর আইনি প্রক্রিয়ায় আস্থা হারাতে বাধ্য করে। অন্যদিকে, সমাজের সেই প্রথাগত মনস্তত্ত্ব নারীর ক্ষমতায়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সমাজ যখন প্রতিনিয়ত নারীকে মনে করিয়ে দেয় যে, তার মূল দায়িত্ব কেবল পরিবারের দেখভাল ও পরিচর্যা করা, তখন নারীর অপার সাহস, মেধা ও দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও দেশের উন্নয়নে তার পূর্ণ অংশগ্রহণের সুযোগ সীমিত হয়ে যায়। কেবল অবকাঠামোগত বা আইনি সংস্কার নয়; বরং এই সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন আনা এবং নারীর প্রতি সহিংসতা নিরসনে বিচার ব্যবস্থার কাঠামোগত সংস্কার নিশ্চিত করাই নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার একমাত্র পথ।