মোস্তফা হায়দারের কবিতায় রাষ্ট্রচিন্তা ও সম্ভাবনার চিত্রকল্প

বাংলা কবিতা আবহমানকাল থেকেই নানান রূপ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের এই অবস্থানে। পরিবর্তন ঘটেছে সাহিত্যের বিষয়বস্তুতে,বিবর্তন ঘটেছে মানচিত্রে,শাসকগোষ্ঠীতে ও শাসননীতিতে। অনিবার্যভাবে সাহিত্যেও ঘটেছে বিষয়বস্তু পরিবর্তন,উদ্ভব হয়েছে নতুন নতুন শব্দ ও শব্দদলের। বর্তমান সময়ে বাংলা কাবিতাকে এগিয়ে নিতে মোস্তফা হায়দার প্রতিভাবান ও প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ কবি। তাঁর কবিতা প্রেরণা আর আবেগের মিশেলে শুরু হলেও পরবর্তীতে প্রজ্ঞার পথে যাত্রা করেছে। তাই তাঁর কবিতায় একটি শান্ত ও মেধাবী উচ্চারণ দেখা যায়। এর মধ্য দিয়ে তাঁর কবিতায় স্পষ্ট হয়েছে সমাজের চিত্র, ভেসে ওঠেছে রাজনৈতিক চিন্তাকল্প। এর ফলে তাঁর কবিতা পেয়েছে পাঠকপ্রিয়তা । এছাড়াও আরও কিছু কারণ চিহ্নিত করা যায়। যেমন, তাঁর কবিতার ভাষার সাবলীলতা ও স্বতঃস্ফূর্ততা। সহজ ও চেনাজানা শব্দের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারা। বিমূর্ততা তার কবিতায় খুব সহজেই মিশে যায় অবচেতনে। তাঁর কবিতায় নেই কোন জটিলতা । আবার একমাত্রিকও নয়। অর্থাৎ তাঁর কবিতার ভঙ্গিমায় মধ্যপন্থা অবলম্বন করেন। তিনি কবিতার মধ্যে ছন্দের এক মুক্ত হওয়া সৃষ্টি করতে পারেন।

কবিতায় চিত্রকল্প সম্পর্কে কবি ও গবেষক সৈয়দ আলী আহসান বলেন– “কবিতার উপদান শব্দ। চিত্রকলার মতো কবিতায়ও শব্দের উপাদানগুলি কখনও বিচ্ছিন্ন হয়ে, কখনও একাকার হয়ে, কখনও তুষারের মতো গলিত হয়ে একটি রূপ বা প্রতীক নির্মাণ করতে হয়।”

একজন কবির সবগুলো কবিতা নিয়মতান্ত্রিক কিংবা কবিতার সব নিয়মকানুন মেনেই লেখা হয় না বা হয়ে উঠে না। যদি সব কবিতা একটি নিয়মতান্ত্রিক পক্রিয়ায় লেখা হতো তা হলে কবিতা লেখার এতগুলো নিয়মের উদ্ভব হতো না,একটি নিয়মেই সীমাবদ্ধ থাকতো। এক্ষেত্রে মোস্তফা হায়দারও এর ব্যতিক্রম নয়। তাঁর কিছু কবিতায় পূর্বসূরি কবিদের প্রভাব লক্ষ করা যায়। বিশেষত ফররুখ আহমদ, আল মাহমুদ,এবং রাজনৈতিক কবিতার ক্ষেত্রে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, ও সুকান্ত ভট্টাচার্য্য–র কবিতার সাথে ঘনিষ্ঠতা লক্ষ করা যায়। তবে, এর মাঝেও মোস্তফা হায়দারের কবিতায় ভিন্নতা ও স্বাতন্ত্রিকতা লক্ষ করা যায়।

একজন মহৎ কবির গুণ হলো সময়কে ধারণ করে লিখতে পারা। অন্যায়ের প্রতিবাদ, সত্য ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য কবিতা লেখা। কবি মোস্তফা হায়দারের মাঝে এই মহৎ গুণটির উপস্থিতি লক্ষনীয়। তিনি প্রতিকূল মুহূর্তেও সত্যের পক্ষে লিখে গেছেন আপন গতিতে। এটা সকলে পারেন না এবং সকলের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না।

কবি–রা ভবিষ্যৎ আন্দাজ করতে পারেন অর্থাৎ দূরদর্শী হন। দূরদর্শী হওয়াটা কবি সত্তার একটা গুণ। এই দূরদর্শিতার মধ্যমে কবিরা আগামীর সতর্কতা এবং সম্ভাবনাকে কবিতার চিত্রকল্পে ফুটিয়ে তুলেন অবলীলায়। কবি মোস্তফা হায়দারের মধ্যে সেই দূরদর্শিতার গুণটি লক্ষনীয়,যা তাঁর কবিতায় স্পষ্ট। দেশে যখন রাজনৈতিক সংকটকে কেন্দ্র করে জাতির ওপর ভয়াবহ নিপীড়ন নেমে আসে তখন কবিতা নেমে আসে সংগ্রামের ময়দানে। তৈরি হয় বাংলা কবিতার নতুন পটভূমি। মোস্তফা হায়দারের মতো রাজনৈতি সচেতন কবির হাত দরে রাজনৈতিক চেতনাসমৃদ্ধ কবিতার উন্মোচিত হওয়ার পথ আরও বেগবান হয়। দু’হাজার নয় সালের সমকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও তার পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক বাস্তবতার স্বরূপ তাঁর কবিতায় চিত্রিত হয়েছে ভিন্ন মাত্রায়। যখন থেকে বাংলাদেশের সাহিত্য অঙ্গন হয়ে পড়েছিল একপেশে ও চাটুকারিতা প্রবণ। যখন থমকে গিয়েছিল সত্যিকার অর্থের সুকমারবৃত্তি।

বাংলাদেশ সবুজ শ্যামল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যভরা একটি দেশ। এদেশের সর্বত্রই সবুজের সমারোহ। সবুজের সাথে মিশে আছে এদেশের সবকিছু। এদেশের পতাকার রঙও সবুজ আর লাল রক্তিম বর্ণে। এদেশ যখনই জালেমের জুলুমের শিকার হয়েছে তখনই কিছু ইনসাফবাদী মানুষ সত্য ও ইনসাফের জন্য লড়াই করেছে। আমাদের মুক্তিকামী জনতাও তাদের ইনসাফের জন্য যুদ্ধ করেছে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়। এই মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার। কিন্তু, একটা সময় দেশের শাসকগোষ্ঠী এসব ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু এসব ভুলিয়ে দিয়ে কেউ বেশিদূর এগিয়ে যেতে পারবে না। যে–কোন অন্যায্যতার বিরুদ্ধে এদেশের মানুষ তাদের অধিকার বুঝে নিয়েছে এবং নিবেই । কবির ভাষায়-‘রক্তাক্ত সবুজ ভূমি ভেসে হয়েছে একাকার / ত্রি সবুজের হিম পাখিটি খেলা করে আনমনে / বাংলা মায়ের বোবা শব্দ কান্না করে নিরবে / অগণতান্ত্রিক সরকারের বেতাল কাণ্ড দেখে। / ছড়ার ছন্দে উঠে গতির প্রতিবাদ / কবিতা গতর ঠেলে করে প্রতিরোধ / গল্পের মাঝে লেখি ‘এ সরকার নিপাত যাক’।/এভাবে আর কতদিন চলবে নিষ্ঠুর হোলি খেলা/সকাল সন্ধ্যায় আর্তনাদের বজ্রপাত ঘটবে/ক্ষমতার করিডোরে বিষাক্ত ছোবল দিয়ে।/জাতিসত্তার ঘুন পোকারা খেয়ে করেছে সাবাড়,/সবুজ বাংলার লেলুপ ক্যাকটাস/ ছারপোকা ও আরশোলার নির্যাতন বেড়েছে / জনগণ ক্ষেপে আছে নিপাতনের নিশাচর দেখতে / অথবা গর্জে উঠার মশাল হাতে তুলে নিতে।” (গর্জে উঠার মশাল, জীবন্ত কঙ্কালের প্রোত মুখ )

গণতান্ত্রিক সরকার সবসময় জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়েই ক্ষমতায় আরোহন করে। কিন্তু তৃতীয়বিশ্বের দেশগুলোতে কিছুকিছু রাজনৈতিক দল একবার জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আরোহন করলে আর ক্ষমতার মসনদ ছাড়তে চায় না। তারা তখন জনগণের সেবক থেকে হয়ে উঠে জনগণের প্রভু। তখন বহিঃবিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোও জনগণের ওপর জেঁকে বসা রাজনৈতিক দলকে ব্যবহার করে বহিঃবিশ্বের দেশগুলো নিজেদের ফায়দার জন্য নানান ফন্দি আঁটে দেশ ধ্বংস করার। জণগণের সেবক থেকে প্রভু বনে যাওয়া নেতারা তখন দেশপ্রেম ও জনগণের স্বার্থ ভুলে গিয়ে দেদারসে অনিয়ম দুর্নীতি শুরু করে,বিদেশে পাচার করতে থাকে দেশীয় সম্পদ। সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীদের কটাক্ষ করে মোস্তফা হয়দারের আরেকটি কবিতা-…‘কাঁচাফুলের মালা গলায়/ গল্প চলে নিচ তলায়।/বুদ্ধিজীবী গলা খাকড়ায় / সময়ে তারা বেল বাজায়। / কোলে রেখে দুলুনী খেলায়/ মিথ্যা কথার বুলি শোনায়। /পাটি পাতার সবুজ মায়া/ দেশে দিলো বলির ছায়া।/ হামাগুড়িতে চলছে দেশ। /মিথ্যা বলার নেইকো লেষ।/পাতাল পুরী কাঁদছে বসে/ সোনার পাত্র পুড়ছে রসে।’ (শিরোনামহীন, জীবন্ত কঙ্কালের পো্রত মুখ)

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আজ অব্ধি এদেশের মানুষ তাদের ন্যায় অধিকার বুঝে পায়নি। যখন যে–ই ক্ষমতায় গিয়েছে শুধু দেশের মানুষকে ব্যবহার করেছে এবং দেশের সম্পদ লুট করেছে। এই দেশীয় রাজনীতিবিদরা সবসময় গরীবকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় গিয়েছে। কিন্তু, তাদের সন্তানরা জনগণের টেক্সের টাকায় বিলাসী জীবন পার করেছে বিদেশে বসে। দেশ, মানবতার পক্ষে সত্যনিষ্ঠ ও সময় উপযোগী অসংখ্য লেখার মাধ্যমে চিত্রিত হয়েছে মোস্তফা হায়দারের রাজনৈতিক কবিতা গুলো। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘বেলা অবেলার নানান শান’, ‘বাংলার কারাগার বিশ্ব স্বাগতিক’, ‘রক্ত খেকো’, ‘বীরের হালখাতা’, ‘ঝুলন্ত লাশের মহরা’ এবং ‘মসনদ’।

কবিরা হয়তো বিপ্লব আনতে পারে না, কিন্তু বিপ্লবের পূর্বাভাস দিতে পারে এবং বিপ্লবকে বেগবান করতে পারে। সম্মোহিত করতে পারে কবির কবিতা। কবিতা বিপ্লবকে প্রেরণায় উদীপ্ত করে স্লোগানকে করে শাণিত। সেরকম কবি মোস্তফা হায়দারের কবিতায়ও ছিল বিপ্লবের পূর্বাভাস। কবির বার্তা যেমন ছিল….‘বিলাসী ও হিংসাত্মক কাণ্ডজড়িয়েছে লতাগুল্ম / দোহাই চলছে গণতন্ত্রের নামে / দোহাই তোমার,পালাবার জায়গা অতি সংকীর্ণ / সামনে ও পেছনে রয়েছে জ্বালাময়ী বিতর্কের কুণ্ডলী / হিংসা ও বিদ্বেষের বিধৌত নীল শাড়ী।” (মসনদ, জীবন্ত কঙ্কালের প্রোত মুখ) বাংলা রক্তস্নাত উর্বর বৈপ্লবিক ভূমি। অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এই ভূমির পূর্বসূরীরা বারবার রক্ত দিয়ে এই ভূমিতে ন্যায্যতা কায়েম করেছেন,আমার বিশ্বাস ভূমিপুত্ররা তা করেই যাবে অনাদি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *