মহাবিশ্ব এই শব্দটার মধ্যেই লুকিয়ে আছে বিস্ময়। আমরা প্রতিদিন যে আকাশ দেখি, তাতে লাখ লাখ তারা, গ্যালাক্সি, গ্রহ আর ধূমকেতু ছড়িয়ে আছে, কিন্তু এই বিশাল সৃষ্টির শুরুটা হয়েছিল এক অদ্ভুত ঘটনার মধ্য দিয়ে যার নাম বিগ ব্যাং। আজ থেকে প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে, মহাবিশ্বের সব পদার্থ, শক্তি, স্থান ও সময় এক ক্ষুদ্র বিন্দুর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সেই বিন্দুতে তাপমাত্রা ও চাপ এত বেশি ছিল যে তা মানুষের কল্পনারও বাইরে। হঠাৎ এক মুহূর্তে সেই বিন্দুটি ফেটে গিয়ে শুরু হয় এক অবিশ্বাস্য বিস্ফোরণ। এই বিস্ফোরণ থেকেই জন্ম নেয় সময়, স্থান, আলো ও পদার্থ। বিস্ফোরণের পর মুহূর্তের মধ্যেই মহাবিশ্ব ফুলে উঠতে থাকে যেমন একটি বেলুনে হাওয়া ঢুকলে সেটি সবদিকে বড় হতে থাকে। প্রথমদিকে মহাবিশ্ব ছিল অন্ধকার ও অতি উত্তপ্ত। তারপর তাপমাত্রা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। তখন সৃষ্টি হয় প্রথম মৌলিক কণিকা প্রোটন, নিউট্রন ও ইলেকট্রন। এই কণিকাগুলো একত্রিত হয়ে গঠন করে প্রথম দুটি মৌলিক উপাদান হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম। কয়েক লাখ বছর পর মহাবিশ্ব ঠান্ডা হতে শুরু করে, তখন আলো প্রথমবারের মতো মুক্তভাবে চলাচল করতে পারে। সেই প্রথম আলোর চিহ্ন আজও বিজ্ঞানীরা টেলিস্কোপে খুঁজে পান “কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন” নামে। এই আলো বিগ ব্যাংয়ের সবচেয়ে বড় প্রমাণ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের মেঘ একত্র হয়ে তৈরি করে প্রথম তারা। সেই তারাগুলোর বিস্ফোরণ থেকে জন্ম নেয় নতুন মৌল কার্বন, অক্সিজেন, লোহা যেগুলো দিয়েই তৈরি আমাদের পৃথিবী, আমাদের দেহ, এমনকি আমাদের নিশ্বাসের বাতাস। অর্থাৎ, আমরা সবাই তারার সন্তান। বিগ ব্যাং কেবল একটি বিস্ফোরণ নয়, এটি আসলে মহাবিশ্বের জন্মের শুরু, যেখানে সময় নিজেই সৃষ্টি হয়। বিজ্ঞানীরা বলেন, বিগ ব্যাং–এর পর মহাবিশ্ব এখনো প্রসারিত হচ্ছে। আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি, সূর্য, গ্রহ, উপগ্রহ সবকিছু ক্রমাগত একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এই প্রসারণ একদিন কোথায় গিয়ে শেষ হবে তা কেউ জানে না। কেউ বলেন মহাবিশ্ব চিরকাল বড় হতে থাকবে, কেউ বলেন একদিন তা আবার ভেতরে ভেঙে পড়বে যাকে বলা হয় “বিগ ক্রাঞ্চ”। কেউ কেউ আবার বলেন, হয়তো এই প্রসারণের কোনো শেষ নেই কারণ আমাদের মহাবিশ্বই একমাত্র মহাবিশ্ব নয়! এখানেই আসে এক রহস্যময় ধারণা মাল্টিভার্স। মাল্টিভার্স ধারণা বলে, আমাদের এই মহাবিশ্বের বাইরে আরও অসংখ্য মহাবিশ্ব থাকতে পারে। প্রতিটি মহাবিশ্বের হতে পারে নিজস্ব নিয়ম, আলাদা সময়, ভিন্ন ভৌত আইন ও আলাদা জীবনধারা। হয়তো কোথাও আলো একটু কম, কোথাও সময় একটু ধীরে চলে, কোথাও হয়তো আমাদেরই মতো মানুষ আছে, যারা আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, “আমরা একা কি?” পদার্থবিদ হিউ এভারেট প্রথম মাল্টিভার্স ধারণা দেন ১৯৫৭ সালে। তার মতে, প্রতিটি সম্ভাব্য ঘটনা নিজস্ব এক এক মহাবিশ্বে বাস্তব হয়ে ওঠে। অর্থাৎ, তুমি এখন এই লেখাটি পড়ছো, কিন্তু আরেক মহাবিশ্বে হয়তো তুমি অন্য একটি বই পড়ছো! বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংও এই ধারণাকে সমর্থন করেছিলেন। তিনি বলেন, “আমাদের মহাবিশ্ব একাধিক সম্ভাবনার মধ্যে একটি।” বিগ ব্যাং হয়তো একবারই হয়নি হয়তো অসংখ্যবার হয়েছে, প্রতিবারই জন্ম নিয়েছে নতুন এক নতুন মহাবিশ্ব। এসব ভাবলে মাথা ঘুরে যায়, কিন্তু এটিই বিজ্ঞানের সৌন্দর্য যেখানে প্রশ্নের শেষ নেই। বিজ্ঞানীরা শক্তিশালী টেলিস্কোপ, যেমন জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ, দিয়ে আজও খুঁজছেন মহাবিশ্বের সূচনা ও সীমা। তারা দেখতে পেয়েছেন যে সবচেয়ে পুরোনো আলোও ১৩.৪ বিলিয়ন বছরের বেশি দূরত্বে ছড়িয়ে আছে, যার মানে আমরা সময়ের পেছনে তাকিয়ে আছি! হয়তো একদিন প্রযুক্তি এত উন্নত হবে যে মানুষ সত্যিই জানতে পারবে আমরা কি একমাত্র মহাবিশ্বে বাস করছি, নাকি অসংখ্য মহাবিশ্বের একটিতে মাত্র? বিগ ব্যাং থেকে শুরু হয়ে মাল্টিভার্স পর্যন্ত এই যাত্রা মানবজাতির কৌতূহল, অনুসন্ধান ও জ্ঞানের প্রতীক। আমরা আজও জানি না শেষ উত্তর কী, কিন্তু জানি প্রতিটি প্রশ্নই আমাদের একটু করে আরও আলোর দিকে নিয়ে যায়। আর সেটাই তো বিজ্ঞানের আসল শক্তি।