বাক্যগুলো আমি লিখি না; এরা নিজেরাই উচ্চারিত হয়, আমি কেবল তা লিখে রাখি

সদ্য নোবেল বিজয়ী কথাসাহিত্যিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই জার্মান ভাষাভাষী বিশ্বে এক প্রভাবশালী সাহিত্যিকতবে ইংরেজিভাষী দুনিয়ায় তিনি এক রহস্যময় ও কৌতূহল জাগানো লেখক হিসেবে পরিচিত। আমেরিকান পাঠকরা প্রথম তাঁর কাজের সঙ্গে পরিচিত হন পরিচালক বেলা তারের মাধ্যমেযার সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ সৃজনশীল সহযোগ শুরু হয় ঊনিশশ আটাশি সালের ড্যামনেশন চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। বেলা তারের বিখ্যাত চলচ্চিত্র সাতানতানগো (১৯৯৪ক্রাসনাহোরকাইয়ের ঊনিশশ পঁচাশি সালে প্রকাশিত উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিতযা বহু বছর পর ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে।

ক্রাসনাহোরকাইয়ের গদ্য জটিলদীর্ঘ ও কাব্যিকতাঁর প্রতিটি বাক্য গভীর চিন্তা ও তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণে ভরা। সমালোচক কলেম তোহবিনের মতেতাঁর ভাষা এক অভিনয়ধর্মী শিল্পযা বাস্তব ও অবাস্তবের সীমা অতিক্রম করে। সাতানতানগোু এর কঠিন ও অন্ধকারাচ্ছন্ন দুনিয়ায় মানবিকতার সূক্ষ্ম আভাস বিদ্যমানযা আমাদের উইলিয়াম ফকনারের লেখার কথা মনে করিয়ে দেয়। ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশের পর ক্রাসনাহোরকাই একটি সাক্ষাৎকার দেন দ্য মিলিয়নস্‌কেযেটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন কবি জর্জ সির্টিস। এখানে সেই সাক্ষাৎকারটির বাংলায়ন করেছেন মাহমুদ আলম সৈকত

দ্বিতীয় অংশ

দ্য মিলিয়নস: ইংরেজিভাষী পাঠক প্রথম আপনাকে চিনেছে আপনার দীর্ঘদিনের সহকর্মী বেলা তারের মাধ্যমে। তাঁর সাড়ে চারশ মিনিট দীর্ঘ ‘সাতানতানগো’ নব্বইয়ের দশকের প্রতিটি চলচ্চিত্র উৎসবের প্রায় স্থায়ী অংশে পরিণত হয়। আপনি যেমন বাক্যকে টেনে নিয়ে যান তার চূড়ান্ত সীমায়, তারও তেমনি তা “লং টেক”–এর পরম সীমায় পৌঁছে দেন। এই তুলনাটি এতই স্পষ্ট যে নিশ্চয় অনেকেই এটির উল্লেখ বা প্রয়োগ করেছেন, কিন্তু আপনি কি তারের এই পদ্ধতির সঙ্গে নিজের কোনো মিল দেখতে পান? তারের সঙ্গে কাজ করার ফলে কি আপনার উপন্যাস রচনার শৈলী কোনোভাবে বদলেছে? আপনি কি কখনও লেখার সময় তারের দৃষ্টিভঙ্গিতে তাদের চাক্ষুষ করেন?

লাসলো ক্রাসনাহোরকাই: আমার ধারণা, যারা তারের সিনেমাকে সত্যিই ভালোবাসে, তারা এটাকে এমনভাবে দেখে না। একজন লেখকের কিছুই লাগে না, সে একেবারেই একা, এবং সেটাই ভালো। কিন্তু একজন পরিচালক একা সিনেমা বানাতে পারে না। তাহলে তারের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কীভাবে কাজ করেছিল? কারণ কেউই আসলে এ নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলেনি এবং হয়তো বলবেও না। তাই আমি এখন প্রায়ই বলি–তার–এর চলচ্চিত্র–চিন্তা বদলে যায় সেই মুহূর্ত থেকে, যখন সে আমার সঙ্গে দেখা করে এবং আমরা প্রথম যৌথ চলচ্চিত্র তৈরি করতে শুরু করি। এই পরিবর্তনের মূল কারণ ছিল আমার কাজের প্রভাব–বিশেষত সাতানতানগো পড়ে সে আমার দৃষ্টিভঙ্গি, আমার চিন্তার ধরণ, আমার শৈলী উপলব্ধি করেছিল।

প্রতিটি বড় গল্পে, প্রতিটি গভীর সৃজনশীল সহযোগিতায়, একজন উৎস থাকে–যেখান থেকে সৃষ্টির প্রবাহ শুরু হয়। আমাদের ক্ষেত্রে সেই উৎস ছিলাম আমি। আমার দৃষ্টিভঙ্গিই নির্ধারণ করেছিল আমরা কী ধরনের চলচ্চিত্র তৈরি করব। তার–এর আগের ছবিগুলো ছিল “সৎ”, সেটাই ছিল তাদের শক্তি, তাদের স্বতন্ত্রতা। আমি সেই সততাকে ভীষণ পছন্দ করতাম, তার ছবিগুলোর মূল নান্দনিকতা ছিল যে, চরিত্রটি যেন মিথ্যা না বলে, যেন কেবল সত্য বলার মধ্যে দিয়েই বেঁচে থাকে। এটাই ছিল এক ধরনের প্রামাণ্য শিল্প। তার অপেশাদার অভিনেতাদের নিয়ে কাজ করতেন, বা এমন অভিনেতাদের নিয়ে, যাদের তিনি ক্যামেরার সামনে সত্য বলাতে পারতেন।

আমাদের দেখা হওয়ার পর তার খুঁজে পেলেন যা তিনি এতদিন ধরে মরিয়া হয়ে খুঁজছিলেন, সেই সাহিত্যিক উপাদান, সেই সম্ভাব্য শৈলী, সেই দৃষ্টিজগৎ ও নাট্যধারা, সেই ছন্দ। আমি তাকে দিলাম আমার সবকিছু, জ্ঞান, শরীর, আত্মা। তিনি সৃষ্টি করলেন এক মৌলিক সিনেমা–আমার শিল্প থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন অথচ সম্পূর্ণ সত্যনিষ্ঠ এক রূপ। আমি তাকে সাহায্য করতে হৃদয় উজাড় করে দিয়েছিলাম, এবং এখন যখন পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি, এই যৌথ কাজগুলোর ফল–তার–এর চলচ্চিত্র–আমার কাছে অত্যন্ত প্রিয়। সত্যি বলতে, তারের চলচ্চিত্রই একমাত্র চলচ্চিত্র যা আমি সহ্য করতে পারি। আমাদের এই সহযোগিতায় কখনও প্রশ্ন ওঠেনি কে চলচ্চিত্রটি তৈরি করছে। আমরা সবসময়ই বলেছি–এগুলো তারের চলচ্চিত্র। তিনিই চলচ্চিত্র উৎসবে গেছেন, যাচ্ছেন, যাবেনও। তাঁরই মুকুট পরা উচিত। আমরা বাকিরা, বিশেষত আমি, এই আনন্দময় ঘটনার গোপন অংশীদার, এবং সেটাই স্বাভাবিক। একটিমাত্র বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ–তার–এর সিনেমা নিজেই। বাকিরা অনুপ্রেরণার উৎস, অভিনেতা, লেখক, সবই গৌণ। চলচ্চিত্র নির্মাণ ন্যায্যতার বিষয় নয়।

দ্য মিলিয়নস্‌: সাতানতানগো–র ডাক্তারবাবুটি মনে করেন, তার নজরে আসা কোনও সামান্য বিবরণ ভুলে যাওয়া মানেই তা মৃত্যুর আগমনী চিহ্ন। “তুচ্ছ বলে মনে হওয়া বিষয়কে উপেক্ষা করা মানে হলো স্বীকার করা যে, বিশৃঙ্খলা ও শৃঙ্খলার মধ্যবর্তী সেতুর ওপর নিরস্ত্র বসে থাকা এক দণ্ডিত মানুষ।” এরপর তিনি মজার ছলে মনে রাখার জিনিসগুলোর তালিকা করেন। কিন্তু এত কিছু মনে রাখাও একধরনের অচলাবস্থা–অন্য এক মৃত্যুর রূপ। আপনার উপন্যাসের গঠন, যা ট্যাঙ্গোর মতো বারবার এগোয়–পিছোয়, সেটাকি এই ‘ভুলতে না পারার’ সমস্যার প্রতিফলন?

লাসলো ক্রাসনাহোরকাই: আমি যা ভুলতে পারি না, তা হলো এই পৃথিবী–যা আমরা তৈরি করেছি। পৃথিবীর সবকিছুই সমানভাবে আকর্ষণীয়, শুধু মানুষ ব্যতীত। আমি যখন পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে নিচে উপত্যকা দেখি–গাছ, হরিণ, ঘোড়া, ঝরনা–আর ওপরে তাকিয়ে দেখি আকাশ, মেঘ, পাখি–সবকিছুই নিখুঁত ও জাদুময়। ঠিক সেই মুহূর্তে, হঠাৎ কোনো মানুষ দৃশ্যপটে এসে পড়লেই সৌন্দর্য ভেঙে যায়। আমি তখন আর কিছুই উপভোগ করতে পারি না।

উপন্যাসের গঠন নিয়ে বলতে গেলে, আমি কখনোই সচেতনভাবে তা ভাবি না। তবে যেহেতু আপনি আগ্রহী, বলতে পারি–গঠনটা আমি ঠিক করি না; এটি জন্ম নেয় আমার চরিত্রদের উন্মত্ততা ও তীব্রতা থেকে। যেন তাদের পেছনে আর কেউ কথা বলছে–কিন্তু কে, আমি জানি না। শুধু এটুকুই জানি, আমি তাকে ভয় পাই। সেই তিনিই কথা বলেন, তাঁর ভাষা পুরোপুরি উন্মত্ত। ফলে স্বাভাবিকভাবেই, আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। গঠন? নিয়ন্ত্রণ? না, সব নিয়ন্ত্রণ তাঁর। তাঁর উন্মত্ততার গতি–প্রবাহই সব নির্ধারণ করে। আর এই উন্মত্ততায় মনে রাখা অসম্ভব; চিন্তাও অসম্ভব–বাকি থাকে কেবল বিস্মৃতি।

দ্য মিলিয়নস্‌: আমি প্রথমে ভেবেছিলাম আপনি এস্টিকে সেই প্রচলিত “জ্ঞানী কিন্তু সরলমনা” চরিত্রে রূপ দিয়েছেন। কিন্তু কয়েক পৃষ্ঠার মধ্যেই সে এক নির্মম কাজ করে বসে। আপনি কি ইচ্ছাকৃতভাবে এই আদর্শটিকে ভেঙে পাঠকের নৈতিক প্রত্যাশা নিয়ে খেলেছেন? অদ্ভুত হলেও, আমি তাকে উপন্যাসের সবচেয়ে মর্মস্পর্শী ও করুণ চরিত্র হিসেবে খুঁজে পাই।

লাসলো ক্রাসনাহোরকাই: এস্টি (হাঙ্গেরীয় “এস্তে” শব্দ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ “সন্ধ্যা”) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। কোনো কোনো পরিস্থিতিতে পরম নিষ্কলুষতা সহজেই নির্মমতায় পরিণত হতে পারে এবং এখানেও তাই হয়েছে। দয়া করে ভাববেন না, যে, এই জ্ঞানী, সরল, নিষ্পাপ মেয়েটির কোমলতা বহন করা সহজ। এস্টির সঙ্গে থাকা মানে অসীম পবিত্রতার সান্নিধ্যে থাকা। কিন্তু পবিত্রতা বিপজ্জনক। পবিত্রতার গঠন সর্বদাই গুরুতর পরিণতি ডেকে আনে। এস্টির এই পবিত্রতা আসে তার ভুক্তভোগী সত্তা থেকে। আর ভুক্তভোগী সবসময় নিজের বেদনায় ভয়ঙ্করভাবে যুক্তিবাদী হয়। একজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে থাকা ভীষণ বিপজ্জনক। আমি তাকে এত ভালোবাসি যে, তার কথা ভাবলেই শারীরিক যন্ত্রণা অনুভব করি।

দ্য মিলিয়নস্‌: সাতানতানগো–র কাঠামোতে ট্যাঙ্গো নৃত্যের পুনরাবৃত্তি, আর দ্য মেলানকোলি অফ রেজিসট্যান্স–এর কেন্দ্রে থাকা ভের্ক মেইস্তে–উভয়েই যেন এক ছন্দময় বিন্যাসের আকাঙ্‌ক্ষা প্রকাশ করে। আমি জর্জ সির্টিসের অনুবাদেও যেন সেই ছন্দের প্রতিধ্বনি শুনতে পাই। আপনি কি লেখার সময় কোনো সংগীত শোনেন? যদি শোনেন, কী ধরনের?

লাসলো ক্রাসনাহোরকাই: না, আমি আমার বাক্যগুলো মাথার ভেতরেই লিখি। বাইরে আছে এক অসহ্য কোলাহল; ভিতরে আছে এক অসহ্য, তীব্র, নীরব ধ্বনি।

দ্য মিলিয়নস্‌: শেষ প্রশ্ন–আমেরিকান পাঠক নিশ্চয়ই সাতানতানগো–র সঙ্গে ফকনারের তুলনা করবেন। দীর্ঘ ছন্দময় বাক্য, অতীতের অভিশাপে জর্জরিত এক মৃতপ্রায় শহর, আর সময়ের অনবরত করাঘাত–এই মিলগুলো অস্বীকার করা যায় না। ফকনারের উপন্যাস, ইংরেজিতে বা অনুবাদে, কিংবা অন্য কোনো আমেরিকান লেখক কি আপনার ওপর কোনো প্রভাব ফেলেছেন?

লাসলো ক্রাসনাহোরকাই: হ্যাঁ, তাদের প্রভাব ছিল অসাধারণ, আর এখন আপনাকে তা স্বীকার করার সুযোগ পেয়ে আমি সত্যিই আনন্দিত। ফকনারের প্রভাব, বিশেষ করে এজ আই লে ডায়িং এবং দ্য সাউন্ড এন্ড দ্য ফিউরি–আমার মধ্যে অবিশ্বাস্য গভীর প্রতিধ্বনি জাগিয়েছিল। তাঁর আবেগ, তাঁর বেদনা, তাঁর চরিত্র, তাঁর ছন্দময় গঠন–সব আমাকে মোহিত করেছিল। তখন আমার বয়স ছিল ষোলো থেকে আঠারো–সবচেয়ে গ্রহণক্ষম বয়স।

আরও কার প্রভাব ছিল? মহান দস্তয়েভস্কির, রহস্যময় এজরা পাউন্ডের, থোরো’র ওয়ালডেন, ন্যাথানিয়েল ওয়েস্টের মিস লোনলিহার্টস–এই তালিকা অনন্ত পর্যন্ত দীর্ঘ। আমি মহান লেখকদের ছাড়া বাঁচতে পারি না, আর এঁরাই আমার কাছে মহত্ত্বের মানদণ্ড। এখনো তাই; আমি এখনো অনুভব করি, আমার বাঁচতে পারা কেবল মহান সাহিত্যাসনে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *