নায়করাজ

নায়করাজ রাজ্জাক ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের এক অনন্য নাম। আমার অভিনয় জীবনের শুরুতে তাঁর হাত ধরেই সিনেমায় আসার সুযোগ হয়েছিল। রাজ্জাক ভাই ছিলেন আমার অভিভাবক, আমার শিক্ষক, আমার সহশিল্পী। আজ তাঁর অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে স্মরণ করতে গিয়ে হৃদয় ভরে যায় স্মৃতি আর শ্রদ্ধায়।

তিনি যেমন এসেছিলেন কিংবদন্তি নির্মাতা জহির রায়হানের হাত ধরে, আমিও এসেছিলাম জহির ভাইয়ের সিনেমার মাধ্যমে। আমরা সতীর্থ। আমাদের প্রথম ছবি ‘সংসার’-এ তিনি ছিলেন আমার বাবার চরিত্রে, আর সুচন্দা আপু ছিলেন মা। এরপর ‘শেষ পর্য্যন্ত’ সিনেমায় আমি হলাম তাঁর নায়িকা। প্রথম ছিলেন পর্দার বাবা, আবার তাঁর সঙ্গেই নায়িকা! এই ভেবে বেশ লজ্জাই পেয়েছিলাম। শুটিং শুরুর পর রাজ্জাক ভাই আমাকে সহজ করে নিয়েছিলেন। সেই থেকে শুরু আমাদের দীর্ঘ পথচলা।

সত্তরের দশকে রাজ্জাক-ববিতা জুটি হয়ে আমরা দর্শকদের হৃদয় জয় করেছি অসংখ্য সিনেমায়। ‘আলোর মিছিল’, ‘অনন্ত প্রেম’, ‘বিরহ ব্যথা’, ‘সোহাগ’, ‘পীচ ঢালা পথ’, ‘টাকা আনা পাই’, ‘মানুষের মন’, ‘বাঁদী থেকে বেগম’, ‘আকাংখা’, ‘স্বরলিপি’, ‘আনারকলি’, ‘রাগী, ‘তওবা’, ‘নাতবৌ’, ‘আগমন’, ‘রাজবন্দী, ‘ভুল যখন ভাঙ্গলো’, ‘অসাধারণ, ‘প্রিয়তমা’, ‘ফুলশয্যা’, ‘প্রফেসর’– অর্ধশতাধিক চলচ্চিত্রে আমরা একসঙ্গে অভিনয় করেছি। এর মধ্যে অমর প্রেমের কাহিনি ‘লাইলী মজনু’ এখনও দর্শকদের হৃদয়ে অমলিন। রাজ্জাক ভাই পরিচালক হিসেবেও রেখেছিলেন সফলতার স্বাক্ষর। তাঁর পরিচালিত ছবিতে আমি অভিনয় করেছি। বেশ গুছিয়ে কাজ করতে ভালোবাসতেন তিনি। 
রাজ্জাক ভাই শুধু পর্দার নায়ক ছিলেন না; বাস্তব জীবনেও তিনি ছিলেন সত্যিকারের নায়ক। পরিবারের সবার সঙ্গে আমার ছিল আপন সম্পর্ক। যে কোনো পারিবারিক অনুষ্ঠানে তিনি আমাকে নিমন্ত্রণ করতেন। আড্ডা, হাসি-আনন্দে কাটত সেই সব মুহূর্ত। তিনি সব সময় শিল্পী আর চলচ্চিত্র নিয়ে ভাবতেন। তাঁর ধ্যান-জ্ঞান ছিল ঢাকাই সিনেমা।

অভিনয় জীবনে তাঁর সঙ্গে অসংখ্য স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ‘অনন্ত প্রেম’ সিনেমার শুটিংয়ের স্মৃতি আজও চোখে ভাসে। ছবির গান ‘ও চোখে চোখ পড়েছে যখনি…’ গেয়েছিলেন খুরশীদ আলম ও সাবিনা ইয়াসমিন; কথা লিখেছিলেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার; সুর করেছিলেন আজাদ রহমান। সেই গানটির শুটিং হয়েছিল কাপ্তাইয়ে; জঙ্গল ও পাহাড় পেরিয়ে তিন দিন ধরে। আশ্চর্যের বিষয়, গানের দৃশ্যের জন্য কোনো নৃত্য পরিচালক ছিলেন না। রাজ্জাক ভাই নিজেই আমাকে সাহস দিয়ে দৃশ্যটির পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি রসিকতার সুরে বলেছিলেন, ‘নৃত্য পরিচালক হিসেবে কিন্তু আমার নাম যাবে পর্দায়।’ 

আমার জন্য তিনি একটি পালকির ব্যবস্থা করেছিলেন; নিজেই খুঁজে এনে দিলেন। শুটিং স্পটে দিনদুপুরে অপহরণ আর মুক্তিপণের ভয় ছিল। তবুও শুটিং শেষ করেছিলাম সাহস নিয়ে। সেই স্মৃতি আজও মনে দাগ কেটে আছে।
রাজ্জাক ভাই নেই–এ কথাটা মেনে নেওয়া আজও কঠিন। আট বছর হয়ে গেল, তিনি আমাদের ছেড়ে গেছেন! কিন্তু তাঁর অবদান, তাঁর ভালোবাসা, তাঁর সংগ্রাম এ দেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে চিরদিন অমলিন থাকবে। সহশিল্পী হিসেবে ছিলেন অনন্য, আর মানুষ হিসেবে অসাধারণ।

তিনি সম্মান দিতে জানতেন, মানুষকে ভালোবাসতে জানতেন। শুটিংয়ে সবাইকে হাসিমুখে রাখতেন। আজ তাঁর প্রয়াণ দিবসে গভীর শ্রদ্ধা জানাই। যতদিন বাংলা সিনেমা বেঁচে থাকবে, ততদিন ‘নায়করাজ রাজ্জাক’ নামটি অমর হয়ে থাকবে। তিনি চোখের সামনে নেই, কিন্তু আছেন প্রত্যেক দর্শকের ভালোবাসায়, প্রত্যেক শিল্পীর প্রেরণায়। সময় যতই গড়াক, রাজ্জাক মানেই বাংলা চলচ্চিত্রের গৌরবগাথা–এক অমর নাম, চিরন্তন কিংবদন্তি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *