‘জীবনের অর্থ মানুষের পাশে থাকা’

২ অক্টোবর ভাষাসংগ্রামী, রবীন্দ্র-গবেষক ও প্রাবন্ধিক আহমদ রফিক চলে গেলেন না ফেরার দেশে। জীবনের শেষ দিনগুলোতে আহমদ রফিক ছিলেন নিঃসঙ্গ। ২০২৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারির এমনই এক নিঃসঙ্গ সকালে রাষ্ট্র, সমাজ, সংস্কৃতি, চলমান ঘটনাবলি ও জুলাই আন্দোলন নিয়ে তাঁর ভাবনা এবং জীবনাভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছিলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আশিক মুস্তাফা 

আশিক মুস্তাফা: পড়েছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানে। নিজেকে চিকিৎসক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। বাম রাজনীতি করতেন। পরে রাজনীতি ছেড়ে লেখকজীবন বেছে নিয়েছেন। একজন সার্বক্ষণিক লেখকের জীবনে একাকিত্ব দুর্বিষহই হওয়ার কথা। আপনি কি সে সময়টা পার করছেন এখন? 

আহমদ রফিক: এক অর্থে হ্যাঁ। তবে এটা ভালো যে এখন আগের মতো লোকজন আসছে না। আমিও নিতে পারছি না। এতে পরিশ্রম কমে গেছে। আরেক অর্থে সময়টা অসহনীয়। কেউ আসে না, খোঁজ নেয় না। পৃথিবীতে কেউই হয়তো এ জীবন চায় না! 

lএই যে কেউ আসছে না, একাকিত্বে সময় কাটছে আপনার। এই সময়টা কি মৃত্যুচিন্তা ভাবায় আপনাকে?

llমৃত্যু যে কোনো সময় যে কাউকে ভাবাতে পারে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমরা তো জীবনকেই চাই। মৃত্যুকে চাই না। জীবন-মৃত্যুকে যদি আলাদা করতে হয়, তাহলে আলাদা করেও তাকে নানাভাবে দেখি। সেই দেখাকে সত্য করে তোলা আমাদের ইচ্ছা ও লক্ষ্য। জীবন এবং মৃত্যুকে বিচ্ছিন্ন করে না দেখে ঐক্যবদ্ধ করে দেখা উচিত। তখন এই দেখাদেখির মধ্য দিয়ে আমরা জীবন-মৃত্যুর দার্শনিক যে অভিধা, সেগুলো একত্র করতে পারব। 

lআমাদের জীবন সংশয়ের মধ্যে চলে। জীবনে কী পেলাম আর কী পেলাম না– এসব তাড়া করে? 

ll শোনেন আমি তখন স্কুলের ছাত্র। নবম শ্রেণিতে পড়ি। একদিন স্কুল লাইব্রেরিতে বই খুঁজতে গিয়ে একটি বইয়ের সন্ধান পাই। সিলেক্টিভ পোয়েমস অব শেলি অ্যান্ড ওমর খৈয়াম। বিদ্রোহী কবি শেলির তুলনা মেলা ভার। শেলি রোমান্টিক কবিও বটে! আসলে তাদের লেখা পড়ে আমার জীবনকে সেই পথেই চালিত করেছি। চলতে চলতে দেখেছি, জীবন আসলেই এক অদ্ভুত সংশয়ের মধ্য দিয়ে চলে। তাতে আমি কী পেলাম কী পেলাম না, কতটা পেলাম, বুঝি কি বুঝি না– এই ভাবনা গুরুত্বপূর্ণ না হলেও এর ভেতর দিয়েই আমরা চলি। অনেকে আবার জীবনের ধর্মীয় দিকটাকে প্রাধান্য দিয়ে সেভাবে জীবনকে চালিত করার চেষ্টা করেছেন। আবার যারা মনে করেছেন এটাই একমাত্র বিবেচ্য বিষয় নয়, আরও অনেক বিষয় বিবেচনার আছে, তারা আবার অন্যভাবে চলেছেন। এগুলো নিয়ে কথা বলা বিপজ্জনক!

lঠিক আছে বিপজ্জনক বিষয় এড়িয়ে অন্যদিকে যাই। আমরা এমন একটা সময় কথা বলছি, যখন ভাষার মাস চলছে। আচ্ছা, আপনি কখন এবং কীভাবে ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন– মনে পড়ে এখন?

llআমি ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিমেদুরতায় ভুগি। সব সময়। স্কুলজীবনে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়াই। সেটা অবিভক্ত বঙ্গে। সে সময় পাকিস্তানপন্থি রাজনীতি করিনি, বাম রাজনীতি করেছি। ’৪৭ সালে কলেজ জীবনে এসেও সেই পথেই হেঁটেছি। ’৪৯ সালে ঢাকায় এসে স্বভাবতই সব গণআন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছি এবং তারই ধারাবাহিকতায় ভাষা আন্দোলনে যোগ দিই। হয়তো এ জন্যই একুশের আন্দোলন সম্পর্কে শুনতে ভালো লাগে। বলতে ভালো লাগে। শুধু তাই নয়, যারা আন্দোলন নিয়ে বলেন তারা আমার কাছের মানুষ হয়ে যান। এই যে আপনি আপন হয়ে গেলেন।

lআপন প্রসঙ্গ এসে ভালোই হলো। আচ্ছা, আপনার পরিবারের কেউ আসে না? পারিবারিক আপন মানুষদের জন্য কী রেখে যাচ্ছেন আপনি? 

llএই প্রশ্নটা এড়িয়ে যেতে পারলেই ভালো হতো। তবু আপনাকে যেহেতু আপন বলেছি তাই বলছি, আসলে সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানায় কখনও বিশ্বাস ছিল না আমার। এখনও নেই। তাই আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি যা ছিল, তা বিক্রি করে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং ব্যক্তি পর্যায়ে অনেককে দান করেছি। নিজের ভবিষ্যতের কথা ভাবিনি। এর জন্য জীবনের শেষ সময়ে এসে অসহনীয় সময় কাটাচ্ছি। পরিবারের আপন কেউ কাছে না এলে, খোঁজ না নিলে সময় কোনোভাবেই ভালো যায় না! তবে আমার এখন সম্পত্তি বলতে আছে বই। এগুলোই রেখে যাচ্ছি মানুষের জন্য। তাতে যদি আপনজনেরা আলোকিত হয়! 

l২০২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থান দেখেছেন। তরুণদের এই আন্দোলন এবং দেশের বর্তমান অবস্থাকে কীভাবে দেখছেন?  

llআমি খুব যে এই বিষয়ে খবর রেখেছি তা নয়। তবে যে একেবারেই জানি না, তাও না। অর্থনীতিবিদদের বিচার-ব্যাখ্যার নিরিখে অর্থনৈতিক খাতে দেশের অগ্রগতি হয়েছে বলা যায়। উৎপাদন বেড়েছে, বাড়ছে ধনী মানুষের সংখ্যাও। তবে একই সঙ্গে শ্রেণিগত বৈষম্যও বেড়েছে ব্যাপক হারে। আমার অভিজ্ঞতার আলোকে বলি, সবার কাছে অনুরোধ, যুগ যুগ ধরে যারাই আন্দোলন করেছেন, আন্দোলনের পরে আন্দোলন করেছেন, তার পরেও আন্দোলন করেছেন; সবার কাছেই আমাদের আহ্বান– সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধ হোন। মিলিত হয়ে কাজ করুন। আন্দোলনের যে ফল তা যেন সঠিকভাবে পরিচালিত হয়। সঠিক পরিণামে পৌঁছায়। যে কোনো আন্দোলনের মতো নিশ্চয়ই এই আন্দোলনেও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ যুক্ত ছিলেন। তাই বলি, সব বয়সের মানুষের মাঝে যেন আমরা মানসিক সংযোগ সেতু গড়তে পারি। এর মধ্যে যাতে ভুলভ্রান্তি যুক্ত না হয়– সেটা দেখা সব মানুষের একান্ত কর্তব্য।   

lপাঠকের উদ্দেশে কিছু বলতে চান?

llএই যে বললাম, সংযোগ সেতু তৈরি করার জন্য। আমি এই কথা বলে আসছি। যে ক’দিন বেঁচে আছি বরাবরই বলব যে, মানসিক ঐক্য দরকার। আমরা এক জাতি এক প্রাণ একতাবদ্ধ হয়ে যদি এগোতে পারি, আমাদের স্বপ্ন কিছু মাত্রায় হলেও সফল হবে। সব বয়সের মানুষের মাঝে যেন আমরা মানসিক সংযোগ সেতু তৈরি করতে পারি। এতে দেশ যেমন এগিয়ে যাবে, তেমনি এগিয়ে যাবে আমাদের বাংলা ভাষাও। আরেকটা কথা বলতে চাই, মানুষের পাশে থাকতে হবে মানুষকে। এটিই জীবনের অর্থ। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *